
করোনার প্রাদূর্ভাবে উভয়সঙ্কটে আছেন শিশুর বাবা-মায়েরা। একসময়ের ব্যস্ত শিশুরা টানা চার-পাঁচ মাস বাড়িতে বন্দি থেকে অস্থির হয়ে উঠছে। অনলাইন ক্লাস আর হোমওয়ার্কের সময়টুকু বাদ দিয়ে দিনের বাকি সময় শিশুদের দুষ্টুমি ক্রমশ বাড়ছে। যারা একেবারেই ছোট, তাদের নানান দুষ্টুমি অনেক সময় ভয়ানক বিপদ ডেকে আনছে। নতুন কোনও জিনিস দেখলে টডলার, অর্থাৎ দেড়-দু’বছরের শিশুদের চেখে দেখতে ইচ্ছে করে। লুডুর গুটি, পেনের ঢাকা, পয়সা বা খেলনার ভাঙা অংশ মুখে পুরে দিলে শ্বাসনালীতে আটকে গিয়ে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। একই সমস্যার সম্ভাবনা থাকে তাড়াহুড়ো করে খেতে গেলে কিংবা শুকনো খাবার শ্বাসনালিতে আটকে গিয়ে, বললেন পশ্চিমবঙ্গের শিশুবিশেষজ্ঞ সৌমিত্র দত্ত।
এরকম হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অথচ কোভিড আবহে হাসপাতালের এমার্জেন্সি সার্ভিস পেতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে ঠিক এইরকমই এক ঘটনার শিকার হয়েছিল নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র, ১১বছরের আরিয়ান দত্ত। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দ্রুত স্যান্ডউইচ খেতে গিয়ে গলায় আটকে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।
অনেক সময় ট্র্যাকিয়া বা শ্বাসনালীতে খাবার আটকে গেলে শিশু কাঁদতে বা কথা বলতে পারে না। এই অবস্থায় শিশুটিকে কাশতে বলতে হবে। কাশলে অনেক সময় গলায় আটকে থাকা খাবার বেরিয়ে যায়।
শিশুবিশেষজ্ঞ মৌপিয়া চক্রবর্তী জানালেন, শ্বাসনালীতে লুডুর গুটি, পেনের ঢাকা বা এরকম শক্ত কিছু আটকে গেলে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ব্রঙ্কোস্কোপি করে শ্বাসনালি থেকে আটকে থাকা জিনিস বার করা ছাড়া উপায় থাকে না। খেতে বসে কথা বলতে নেই, বড়দের এই কথাকে আধুনিক মানুষ আমলই দেননা।
খেতে বসে কথা বলা তো উচিতই নয়, পাউরুটি বা বিস্কুটের মতো শুকনো খাবার খেলে সঙ্গে দুধ, সুপ বা পানি রাখা উচিত ।
খেতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করলে শুধু যে শিশুরাই বিপদে পড়ে তা নয়, বড়দের জন্যও তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে বলে জানালেন চিকিৎসক সৌমিত্র দত্ত। আমরা অনেকেই ফুটবলপ্রেমী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত সুব্রত কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সঙ্গে পরিচিত। অথচ এই ফুটবলপ্রেমী মানুষটি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে আকস্মিক ভাবে গলায় খাবার আটকে মারা যান।
খাবারের টুকরো গিলতে গিয়ে বিষম খেয়েই হোক বা ফরেন বডি গলা দিয়ে শ্বাসনালীতে আটকেগিয়ে প্রাণঘাতী সমস্যা হয়। শ্বাসনালীতে কিছু আটকে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। এর ফলে নিঃশ্বাসের কষ্ট আর কাশি অবধারিত। শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ার ডাক্তারি নাম অ্যাস্পিক্সিয়া। শ্বাসনালী একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে অক্সিজেন সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট ও ব্রেন অক্সিজেনের অভাবে কাজ করতে পারে না। শরীরের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় অবিলম্বে কৃত্রিম উপায়ে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ শুরু না করলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
বিষম খাওয়া ছাড়াও অনেক সময় ছোট শিশুরা খেলার ছলে ছোটখাটো কিছু নাকে বা মুখে ঢুকিয়ে ফেললে একই সমস্যা হয়। ঠিক যেমনটি চার বছরের ছোট্ট মেয়ে পাপড়িদে-র হয়েছিল। খেলতে খেলতে পেনের ঢাকা গিলে ফেলেছিল। সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে শিশুটাকে বাঁচানো যায়নি। অনেক সময় ছোটখাটো জিনিস নাকে ঢুকিয়ে দিলে চট করে বোঝা যায় না। শিশুরাও বলতে ভয় পায় বা বলতে পারে না।
শিশুই হোক বা বয়স্ক মানুষ, গলায় কিছু আটকে গেলে কয়েকটা লক্ষণ দেখলে অবিলম্বে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, এখানে সময়ের দাম অনেক বেশি। সময় নষ্ট করলে জীবন দিয়ে তার দাম দিতে হবে। শ্বাসনালীতে কিছু আটকে গেলে প্রথমেই মানুষটির নিঃশ্বাসের কষ্ট হবে। এর জন্যে কাশি হবে, বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ, বমি বা বমি বমি ভাব, কথা বলতে না পারা, অক্সিজেন ইনটেক একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে রোগীর ঠোঁট নীল হয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরকম লক্ষণ দেখলে দেরি না করে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন সৌমিত্রবাবু।
করোনার সময়ে শিশুদের দিকে একটু বাড়তি নজর রাখতে হবে। দেড়-দু’বছরের শিশু বাড়িতে থাকলে তার হাতের কাছে ছোটখাটো জিনিস না রাখাই ভাল। খাওয়ানোর সময় বেশি তাড়াহুড়ো করবেন না, জোর করে শিশুর মুখে খাবার গুঁজে দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করার চেষ্টা করবেন না।
সুত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা