
একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক৷
আরিফ একজন মাঝারি ব্যবসায়ী৷ গ্রাম্য দোকানে তার একটা রড সিমেন্টের দোকান আছে৷ সে দোকানের আয় দিয়েই তার সংসার চলে৷ দুই ছেলে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে৷ প্রতি মাসে সন্তানদের মাসিক বেতন দিতে হয় দেড় হাজার টাকা৷ ভর্তি, পরীক্ষার ফিসসহ আরো মোটা অংকের ব্যয় তো আছেই! তার বন্ধু হানিফ তহশিল অফিসের চাকরি করেন৷ তারও দুই সন্তান পড়াশোনা করে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে৷ মাসিক বেতন দুইজনের ৪০-৫০টাকা৷ সরকারি চাকরি করে বিধায় হানিফ সাহেব সরকার কর্তৃক সন্তানের পড়াশোনার জন্য মাসিক এক হাজার টাকা শিক্ষা ভাতাও পান৷ আরিফের আক্ষেপ একই দেশে বাস করে একজনের সন্তান সরকারি স্কুলে নামে মাত্র টাকায় পড়াশোনা করবে এবং অন্যজনের সন্তান পড়াতে পকেট কাটা যাবে কেন?
গত বছর আরিফ বাড়ির পাশে এক খন্ড জমি কিনেছে ৬ লাখ টাকা দিয়ে৷ এতে সরকারকে রেজি. বাবদ প্রায় ৭২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে৷ প্রতি বছর ইউনিয়ন পরিষদে বাড়ির খাজনা দিতে হয়৷ ব্যবসা চালাতে গিয়ে ব্যবসায়ী লাইসেন্স বাবদ সরকারকে ফিস দিতে হয়৷ ইনকাম টেক্স, দোকান চালাতে আরো অন্যান্য টেক্স, ব্যাংকিং লেনদেনসহ অন্যান্য খাতে টেক্স দিতে হয়৷ আরিফের হাফছাড়া আক্ষেপ সরকারকে সর্ব দিকে টেক্স দিয় সে, সরকার অন্তত তার সন্তানকে ফ্রি পড়াশোনার সুযোগ দিবে না কেন?
স্বাধীনতার ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭৬০ গুণ৷ ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরের বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা আর ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাজাটের আকার বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকার উপরে৷ বাংলাদেশ এখন নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সক্ষমতা দেখিয়েছে৷ ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল তো আছেই৷ জাতীয় বাজেটের ব্যয় মিটাবার জন্য এখন আর বিদেশী সাহায্যের দিকে তাকাতে হয় না৷ বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়েছে ৭৬০ গুণ কিন্তু ৭৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও সরকারিকরণ হয়নি! রাষ্ট্রে বসবাসরত সবাই সরকারকে টেক্স প্রদান করে থাকে৷ কর প্রদানের পরিমাণ হয়ত কারো বেশি কারো কম৷ কিন্তু সরকারি সকল স্থাপণা ও নির্মাণ সকল নাগরিকের ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না৷ পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি বড় বড় বিশ্বনন্দিত স্থাপণাগুলো বাংলাদেশের গৌরব বো অহংকার কিন্তু এতে সকল নাগরিক সমান সুযোগ পাবে না; কিন্তু সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে দেশের সকল শ্রেণির লোক সমান সুযোগ পাবে৷ এতে শিক্ষার উন্নয়ন এ শিক্ষার হার উভয় বাড়বে এবং কেউ অর্থের অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না এবং বৈষম্যও আর থাকবে না৷ বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে ৩০ লক্ষ লোকের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে; আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও শিক্ষা অর্জনে মানুষ নানাবিদ বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে!
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে সর্ব শ্রেণির লোক এতে সুবিধা পাবে৷ কেউ ২০টাকা মাসিক বেতন দিয়ে পড়বে আবার কেউ ২ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়ে পড়বে এগুলোর বিলুপ হবে৷ পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রেও একই যোগ্যতা নিয়ে একই কাজ করে কেউ শতভাগ পাবে, কেউ সিকিভাগ পাবে ইত্যাদি বৈষম্যগুলোও আর থাকবে না৷ বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে কোনো আয় বা আয়ের উৎস ছিল না; কিন্তু বর্তমান সরকার ২৬হাজার ১০০ স্কুল সরকারিকরণ করেছে৷ আর কোটি কোটি টাকা ফান্ডে ভরপুর মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার জাতীয়করণ করতে অক্ষমতা থাকার কথাই না! এখানে নিশ্চয় একটি অদৃশ্য পর্দা সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুরত্ব ও অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে রেখেছে৷ সরকার একটি ভালো করে আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকালেই সে পর্দা সরিয়ে দেশের সকল মানুষকে বিনা খরচে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে বৈষম্য নিরসন করতে পারে৷
লেখক- মোহাম্মদ মহসিন মিয়া, শিক্ষক৷