মাওয়ার পদ্মাপাড়ে ঘুরাফেরা ও ইলিশ ভাজা খাওয়ার অভিজ্ঞতা

প্রদীপ কুমার সাহা : জেলা প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ।
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নয়নাভিরাম অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে দর্শনীয় স্থান। তবে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা নদীতে নৌকা ভ্রমণ, সবুজের মাঝে জ্যোৎস্নার খেলা খেলতে গিয়ে আপন মনে হারিয়ে যাবার মতো একটি অতি উত্তম স্থান হলো মাওয়ার পদ্মার পাড়। রাজধানীর যান্ত্রিক জীবনের ধরাবাঁধা নিয়ম, কোলাহল, শব্দ ও বায়ু দূষণ এবং নগর জীবনের ক্লান্তির ছাপ এড়িয়ে শহর ছেড়ে একটু মুক্ত বাতাসে অবগাহনের উৎকৃষ্ট ভেন্যু এটি। যদি দেহ ও মনে প্রশান্তির পরশ পেতে চান তবে ঘুরে আসতে পারেন ব্যস্ততম ঢাকা শহর থেকে মাত্র ৩৫ কি.মি দূরে মাওয়া এবং সেখান থেকে ৪ কি.মি দূরত্বের মধ্যে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে। এখানে রয়েছে সুবিশাল পদ্মার পাড়, পদ্মা রিসোট ও মাওয়া রিসোট সহ আকর্ষণীয় কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র। স্বচক্ষে দেখে আসতে পারেন পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অগ্রগতি। বিশেষজ্ঞদের ভাবনা, পদ্মা সেতু আর পায়রা সমুন্দ্র বন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চল হবে স্বপ্নের সিংগাপুর।
প্রতিদিন উচ্ছাস আর আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে পদ্মার পাড়। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে রাখে পদ্মা পাড়ের মানুষ। দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সাড়ে তিন কোটি মানুষের ঢাকায় প্রবেশদ্বার হচ্ছে মাওয়া। আর এই মাওয়াতেই নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যার ৮৭ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মায় প্রবল খরস্রোতের কারণে প্রায় তিন মাস যাবৎ পদ্মা সেতুতে স্প্যান বসানোর কাজ বন্ধ রয়েছে। গত ১০ জুন ৩১তম স্প্যান বসানোর পর বর্তমানে আরো ৫টি স্প্যান সেতুতে বসানোর উপযোগী করে রাখা হয়েছে। আশা করা যায়, এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হবে। এপাড় ওপাড় মিলিয়ে ৫৫ কি.মি দীর্ঘ চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ে গত ১২ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। সংগে দুইপাশে রয়েছে পৃথক দুইটি সার্ভিস লেন। বিরামহীন চলার জন্য ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রয়েছে ছয়টি ফ্লাইওভার, ৩১টি ছোটবড় সেতু। তাছাড়া স্থানীয় পরিবহনের নিরবচ্ছিন্ন চলার সুবিধার্থে রয়েছে ১৯টি আন্ডারপাস। ইতিহাসের সর্বাধিক ব্যয়বহুল এই এক্সপ্রেসওয়েতে ঘন্টায় ৮০ কি.মি গতিতে গাড়ি চালানো সম্ভব। মহাসড়কে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন যাত্রীছাউনী।
ঢাকার গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও গাবতলী থেকে মাওয়ার বাসে চড়তে পারেন। ঢাকা শহরের কোলাহল ছেড়ে কিছুটা পথ এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ। যাত্রাপথে এক্সপ্রেসওয়ের নান্দনিক দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি চোখে পড়বে আমিন মোহাম্মদ, গোল্ডেন সিটি, বসুন্ধরা সহ বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পের নজরকাড়া সাইনবোর্ড। বিরামহীন চলার পথে চোখে পড়বে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারে বন্দী হাজতি, আসামীদের নৈতিক অবক্ষয়ের কথা এবং সেইসাথে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে আমাদের সুশীল সমাজের দায়বদ্ধতার কথা ভাবতে ভাবতেই একসময়ে পৌঁছে যাবেন আপনি আপনার গন্তব্যস্থলে।
মাওয়া বা শিমুলিয়া ঘাটে ঘুরতে আসা সকলের প্রধান আকর্ষণ থাকে পদ্মার রূপালী ইলিশের প্রতি। পদ্মার গভীর থেকে সদ্য ধরে আনা ইলিশের স্বাদ পেতে চাইলে আসতে হবে শিমুলিয়া ঘাটে। এখানে প্রতিদিন ইলিশ খেতে আসে ভোজন রসিকরা। যুগ যুগ ধরেই এখানে ইলিশের চাহিদা অত্যাধিক। যদি জেলেদের কাছ থেকে তাজা ইলিশ কিনতে চান তাহলে খুব সকালে মাওয়ার পুরানো ফেরিঘাটে যেতে হবে। আর যদি ইলিশ ভাজা খেয়ে তৃপ্ত হতে চান তাহলে দিন বা রাতের যে কোন সময়ে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে চলে আসলেই হবে। ইলিশের স্বাদে সুগন্ধ ছড়াতে ফেরি বা লঞ্চযাত্রীদের সুবিধার্থে শিমুলিয়া ঘাটে গড়ে ওঠেছে ছোট বড় অনেক হোটেল । বা্ঙ্গালী মানেই ভোজনরসিক। ইলিশ বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ। বাঙ্গালীর খুশিতে ইলিশ, উৎসবে ইলিশ এমনকি কুটনীতিতেও ইলিশের গন্ধ পাওয়া যায়। ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও অমৃতের স্বাদ পাওয়া যায় মাওয়ার পদ্মার ইলিশে।
ইলিশের সবকিছুই সুস্বাদু । পুরো মাছ, মাথা, ডিম, লবন দিয়ে রাখা নোনা ইলিশও কম স্বাদের নয়। ডিম ছাড়া ইলিশের স্বাদ বেশি। চন্দনা ইলিশও আছে , যা আকারে বড় , কালো হলদে রংয়ের হয়। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কাটার পর ইলিশ মাছ আর ধুতে নাই। যদি রক্ত লেগে থাকে তাহলে উচিৎ কাটার পর সূতি কাপড় দিয়ে রক্ত ভালোভাবে মুছে ফেলা।
যে কোন হোটেলে ঢোকার পূর্বেই আপনাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে হোটেলের অবস্থান, পরিবেশ, মাছের আকৃতি ও দরদাম নিয়ে। সারি সারি সাজিয়ে রাখা কাটামাছ কখনই অর্ডার করবেন না। কারণ ঐগুলো আসল ইলিশ নয়। চন্দনা ইলিশ বা বাসি পঁচা ইলিশ। ডিপ ফ্রিজ থেকে দেখে শুনে যাচাই করে গোটা মাছ কেনার চেষ্টা করুন। ৫00 টাকার মধ্যেই হয়তো পেয়ে যাবেন আপনার কাঙ্খিত স্বাদের ইলিশ। এবার হোটেল বয়কে ডেকে আপনার মেন্যু বলতে হবে। তাৎক্ষণিক ওরা তৈরি করে দেবে আপনার পছন্দের ইলিশটি দিয়ে।তবে মসলা দিয়ে রান্না করা ইলিশের চেয়ে ইলিশভাজা ও লেজের ভর্তাটা খুবই সুস্বাদু। ইলিশের ভাজা ও ভর্তা খেতেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ শিমুলিয়ায় জড়ো হয়। তখন তাদের মনে অভিব্যক্তি দাঁড়ায় , আহ! কী সুন্দর সুশ্রী ঘ্রাণ। এ যেন স্বর্গ সুখের চেয়েও লোভনীয়।
মৎস্যকুলপতি ইলিশ দিয়ে হরেক রকমের আইটেম রান্না করা যায়। যেমন- সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ, ইলিশ পাতুরী, ইলিশ ঝোল, ইলিশ পোলাও, ইলিশ খিচুড়ি, ইলিশ ভুনা ও ইলিশ ভর্তা। রান্নায় পদের শেষ নেই। কিন্তু শেষ কথা একটাই ইলিশের গন্ধ। কোথায় নেই গন্ধ? থালায় গন্ধ, গ্লাসে গন্ধ, হাতের তালুতে গন্ধ। সর্বত্রই শুধু সুস্বাদু ইলিশের সুবাসিত সুগন্ধ।
দুপুরের পর সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত নদীতে দেখা যাবে সূর্যের রূপালী ঝিলিক। মৃদু বাতাসে নদীর জলে ছোট ছোট রূপালী ঢেউ ঝলকে দেবে চোখ। পদ্মা পাড়ের বিস্তৃত প্রান্তর, বিকশিত করবে মোদের দেহ মন অন্তর।
যদি ইচ্ছে হয় স্পিড বোটে চড়ে পদ্মার বুকে দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়াতে পারেন। নদীতে চলাকালীন চোখে পড়তে পারে, নদীর উপর দিয়ে একলা নিঃসঙ্গ কোন বক বা এক ঝাক গাংচিল উড়ে যাচ্ছে ওদের কোন এক আশ্রয়ের সন্ধানে।
ইউরোপের বৃহত্তম নদী রাইনকে কেন্দ্র করে যদি পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠতে পারে , তবে পদ্মাকে ঘিরে কেন তা সম্ভব হবে না? তাইতো পদ্মাকে কেন্দ্র করে নয়নাভিরাম ও অপরূপ সাজে সজ্জিত করে পদ্মার রিসোট তৈরি করা হয়েছে। ১৬টি ডুপ্লেক্স কটেজ নিয়ে তৈরি হয়েছে পদ্মা রিসোট। যার ১২টি কটেজের নামকরণ করা হয়েছে বাংলা বারো মাসের নাম অনুযায়ী। বাকী ৪টি করা হয়েছে বাংলার ছয় ঋতুর নামানুসারে ।
এছাড়া মাওয়ার পুরাতন ফেরিঘাট হতে সামান্য দক্ষিণে মাওয়া ভাগ্যকুল রাস্তার কান্দিপাড়া গ্রামে ২৩ বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে মাওয়া রিসোট। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত এটি একটি অন্যরকম পর্যটন কেন্দ্র। প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে ভরপুর, নিরাপদ আর নির্জন পরিবেশে ঘুরাফেরার জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা। প্রধান ফটকে ঢুকতেই চোখে পড়বে সুবিশাল একটি দীঘি। দীঘির চারপাশে সারি সারি নারিকেল আর সুপারি গাছের সমারোহ। দীঘিতে রয়েছে ইঞ্জিন চালিত আধুনিক বোট। পাড়ে রয়েছে উন্নতমানের ক্যাফেটেরিয়া। পুকুরের পূর্ব প্রান্তে আছে রাত্রীযাপনের জন্য ১৮টি কটেজ। রাতে নির্জন গ্রামের রাশি রাশি জোনাকী পোকার ম্লান আলোর আভায় রং বেরংয়ের বৈদ্যুতিক বাল্বগুলোকে বড়ই অসহায় মনে হয়। রাত্রীযাপনের ইচ্ছে থাকলে এগুলোর যে কোন একটির অস্থায়ী অধিবাসী আপনিও হতে পারেন।