বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্হা : জাতীয়করণ ও সম্ভাবনা। 

প্রকাশিত: ৪:১০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০

আমরা সকলেই জানি, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড এবং চালিকা শক্তি। একটি জাতি তার উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে যদি সে জাতি তার শিক্ষায় প্রত্যাশিত উন্নতি করতে পারে।

 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযোদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে  কোন প্রকার বৈষম্য থাকবেনা — এটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা।

 

 আমাদের নাগরিক মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষা। বৈষম্যহীনভাবে শিক্ষা দান এবং শিক্ষা গ্রহন করতে পারা, এদেশের সব মানুষের অধিকার। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্হা গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার অবকাঠামো। শিক্ষার্থীরা কোথায় বসে পড়বেন ; তা ঠিক যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, ততটুকুই গুরুত্বপূর্ণ কে তাকে পড়াবেন।স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়, শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহন প্রক্রিয়াটি সমান গুরুত্ব বহন করছে।

 

বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্হা নিঃসন্দেহে একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্হা কারণ শিক্ষাকে সরকারী আর বেসরকারি এই দুই ভাগে ভাগ করে চরমভাবে তার শিখন ফলকে বাধাগ্রস্হ করা হচ্ছে। বেসরকারির মধ্যে আবার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান নামে আরো একটি উপ-বিভাগ রয়েছে,যারা কোন সরকারি সুযোগ সুবিধার ধার ধারে না।

 

বেসরকারি শিক্ষক – কর্মচারীদের আরেকটি অংশ এমপিওভুক্ত হিসেবে পরিচিত।তারা এমপিও থেকে প্রতি মাসে  সরকারি স্কেলেরর সমান ভাতা পায়, তার সাথে ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা মেডিকেল ভাতা, দুটি ২৫% উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখি ভাতা।

 

যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার কথা সংবিধান স্বীকৃত, সেখানে প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) প্রতিষ্ঠানে বেশি বেতন দিয়ে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু সরকারী স্কুলের একজন শিক্ষার্থী কম টাকা বেতন দিয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছে।

 

শিক্ষাব্যবস্হার সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, অধিদপ্তর,  বা আঞ্চলিক কার্যালয়, শিক্ষা বোর্ড, জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা শিক্ষা অফিস — এদের কোনটিই কিন্তু বেসরকারি নয়।  এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবাই প্রজাতন্ত্রের  সরকারি বেতনভুক্ত লোকবল। অথচ এরা যাদেরকে পরিচালনা করে তাদের ছোট একটি অংশ সরকারি, আর বড় একটি অংশ বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত। অতএব দেখা যাচ্ছে, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীগণ নামে বেসরকারি কিন্তু আইনে সরকারি। এই অনিয়মতান্ত্রিক ও সংবিধান পরিপন্থী নীতি থেকে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ মুক্তি চায়। মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্হার জাতীয়করণ করা।

 

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়,  “ভবিষ্যতে তুমি কী হতে চাও?” অধিকাংশই উত্তর দিবে, ” আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হতে চাই।”  কতজন তার উত্তরে বলবে, “আমি শিক্ষক হতে চাই, তা একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।”  তার একমাত্র কারণ হচ্ছে,দেশের বড় একটি শিক্ষকশ্রেণী শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে অর্থাভাবে ভোগে এবং তার আর্থিক চাহিদা মেটাবার জন্য প্রাইভেট টিউশনি কিংবা ছোটখাটো ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। তাই, খুব কম শিক্ষার্থীই স্বপ্ন দেখে যে, আমি শিক্ষক হব। অতএব, মেধাবীদের শিক্ষকতায় আগ্রহী করার জন্যও শিক্ষাব্যবস্হার জাতীয়করণ প্রয়োজন।

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে  দেশের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণ শুধু একটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই না। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। এই শিক্ষাবান্ধব সরকার ২০১৩ সালে ২৬ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছে। পাশাপাশি বিগত সংসদ নির্বাচনে ‘ নির্বাচনী ইশতেহার ‘ অনুযায়ী যে সকল উপজেলায় সরকারী স্কুল – কলেজ নেই, এমন প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারীকরণ করেছে যা নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাবার যোগ্যতা রাখে। এই উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখতে এবং বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্হা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক – শিক্ষার্থীদের  মুক্তি দিতে পারে একমাত্র জাতীয়করণ।

 

শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব সায়েদুল হাসান সেলিম বলেন, শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণ ছাড়া সরকারি – বেসরকারি বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।বিক্ষিপ্ত জাতীয়করণ শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি করছে।জাতীয়করণের জন্য সরকারে আন্তরিক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট।

 

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সরকার শিক্ষকদের যে টাকা দেন তার সঙ্গে প্রায় দুই হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকা যোগ  হলেই শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণ সম্ভব। প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ ছাত্রছাত্রীর বেতন, সেশন চার্জ, রিজার্ভ ফান্ড, সাধারণ তহবিল ও অন্যান্য উৎস থেকে সরকার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাবে। জাতীয়করণের পরও সরকারের এক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।(যুগান্তর, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)।

 

অতএব বঙ্গবন্ধু কন্যা, মানননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজের আকুল আবেদন, মুজিববর্ষেই শিক্ষাব্যস্হার জাতীয়করণ ঘোষণা করে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ শিক্ষক – কর্মচারীর হৃদয়ে মনিকোঠায় আপনার অবস্হান সুসংহত করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক:

মো.আশরাফুল লতিফ (তুহিন),

প্রভাষক (ইংরেজি),

গোপীনাথপুর আলহাজ্ব শাহআলম ডিগ্রী কলেজ।

কসবা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি।

বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম।

সহ – বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের ফোরাম।


Categories