
এমপিওভুক্ত প্রভাষকদের সহকারী অধ্যাপক পদ প্রাপ্তির জন্য এসিআর পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করতে যাচ্ছে নীতিমালা সংশোধন কমিটি। সরকারি কলেজে ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে।তবে পার্থক্য হল সরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতির জন্য ডিপারমেন্টাল পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষকদের।
আর বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসায় পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা দিতে হয় না। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৫:২ অনুপাতে পদোন্নতি পেতেন। তবে নতূন করে ১০০ নাম্বার মার্ক নির্ধারণ করে পদোন্নতি দেওয়া হবে। তন্মধ্যে ১০+১৫=২৫ মার্ক এসিআর ও উপস্থিতির জন্য নির্ধারিত থাকবে। এই ২৫ মার্কের “ত্রাণকর্তা” হবেন বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসার সম্মানিত অধ্যক্ষ বৃন্দ।
আর সেই কাংখিত নাম্বার সে সকল সৌভাগ্যবান প্রভাষক ও শিক্ষকগণ অনায়াসে পেয়ে যাবেন যাদের সাথে প্রধানের অন্য রকম দহরম-মহরম সূ-সম্পর্ক রয়েছে।আর সেই “কাংখিত সম্পর্কের” কতগুলো মাপকাঠি প্রচলিত আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেগুলো
যথা, আর্থিক লেনদেন, দাতা-প্রতিষ্ঠাতাদের নিকট আত্মীয়, স্থানীয় প্রভাবশালী শিক্ষক,প্রধানের আর্থিক অনিয়মের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগী, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষক, সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষক ইত্যাদি।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান(স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসা) সমূহে মেধাবী সৎ তরুন ডেডিকেটেড শিক্ষক গণ নানাবিধ কারণে প্রধানের সাথে সূ-সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না বলে কিংবদন্তি আছে।অধিকতর কম যোগ্যতা সম্পন্ন দূর্বল ফাঁকিবাজদের সাথে সূ-সম্পর্ক ঠিকই বজায় থাকে। এর পেছনে প্রতিষ্ঠানের আয় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ফলে তারা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত না থেকে ও শিক্ষক হাজিরা খাতায় দেদারসে উপস্থিতির স্বাক্ষর বসিয়ে দিতে সক্ষম হন। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এ রকম অনেক ঘটনা সম্পর্কে বিজ্ঞ মহল সম্যক অবগত রয়েছেন।
অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান রয়েছেন যারা নিজেরা সৎ বলে আর্থিক অনিয়মে জড়িত নহেন এবং সৎ মেধাবী শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে থাকেন। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিরোধার্য অভিভাবক বলে বিবেচিত হন। তবে তাদের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। এ রকম পরিস্থিতিতে এসিআর বা গোপন প্রতিবেদন ও উপস্থিতির মার্ক মেধাবী কর্মট প্রভাষক ও শিক্ষকদের পাহাড়সম বৈষম্য গড়ে তুলবে। ফলে সৎ মেধাবী শিক্ষক পদোন্নতি বঞ্চিত হবে নিশ্চিত। ফাঁকিবাজ ও অযোগ্যরা প্রধানের বদান্যতায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে। তখন সৎ মেধাবী পদোন্নতি বঞ্চিত থাকবে।
নচেৎ তাদের অনেকেই পদোন্নতির জন্য চারিত্রিক সতততা বিসর্জন দিতে বাধ্য হবেন।ফলে দেশ নৈতিকতাহীন এক অন্ধ জাতিতে রুপান্তরিত হবে। উন্নত সভ্য বিশ্ব বিনির্মাণে কুঠারাঘাত হানবে।
তবে এসিআর পদ্ধতি চালুর আগে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের তিন বা পাঁচ বছর পর পর বদলি বাধ্যতামূলক ও তাদের নিয়োগের ক্ষমতা এনটিআরসিএর হাতে ন্যস্ত করা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। ড:ফরাস উদ্দিন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয় সরকারি কোষাগারে জমা বাঞ্ছনীয়। তদুপরি পদোন্নতির জন্য সরকারি কলেজের মত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা অপরিহার্য। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার সভাপতির দায়িত্ব জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের হাতে ন্যস্ত করা চুড়ান্ত অনুধাবন যোগ্য। তখন এসিআর হয়ত ভালো কিছু দিতে পারবে। কারণ লোকাল সভাপতির হাতে শিক্ষক সমাজ প্রায় সকল পাঠশালায় লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হচ্ছে তা প্রমাণিত সত্য।
আমাদের দেশে অনেক সম্মানিত প্রতিষ্ঠান প্রধান রয়েছেন যারা সহকর্মী শিক্ষকদের সাথে দানবের মত আচরণ করেন। কথায় কথায় চাকরিচ্যুতির হুমকি,ঠুনকো অজুহাতে বেতন-ভাতা বন্ধ সহ দৈনন্দিন নানাবিদ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে তটস্থ রাখেন। তখন এসিআর নামক পদোন্নতির সিঁড়ি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চরম অস্থিরতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অনেক ক্ষেত্রে এসিআর নামক গোপন প্রতিবেদনের জন্য হানাহানির ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
ফলে এ ধরণের মানসিকতা সম্পন্ন প্রধানদের হাতে শিক্ষকদের গোপন প্রতিবেদনের দায়িত্ব প্রদান কিছুতেই নিরাপদ নহে। একটি ঘটনার উল্লেখ বিষয় টি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি ফাজিল মাদ্রাসা। পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিয়ে চরম দ্বন্ধ দীর্ঘদিনের। অধ্যক্ষ তার পছন্দের ব্যক্তির জন্য এমপির ডিও দিয়ে কমিটি অনুমোদন করে আনলে প্রতিপক্ষ হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। আবার অপরপক্ষ সভাপতি পদে এমপির ডিও নিলে অধ্যক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। কোন কারণে অনুমোদন হলে তিনি ও হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এভাবে বিগত দশ বছর যাবৎ মাদ্রাসায় পরিচালনা কমিটি অনুপস্থিত।
এমতাবস্থায় অধ্যক্ষ কখনো এডিসি কখনো জেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতিস্বাক্ষরে বেতন-বিল ব্যাংকে জমা দিয়ে মাদ্রাসার বেতন উত্তোলন করান। এক সময় অধ্যক্ষ নিজের প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রাসার ভাইস-প্রিন্সিপালের বেতন দুই মাস আটকে দেন। তখন তিনি প্রতিস্বাক্ষর কারি জেলা শিক্ষা অফিসারের দ্বারস্ত হলে তিনি উপাধ্যক্ষের বেতন প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। নিজের বেতনের কপি নিয়ে জেলা সদর থেকে উপজেলার সংশ্লিষ্ট সোনালী ব্যাংকের উদ্দেশ্যে রওনা দেন উপাধ্যক্ষ।
ব্যাংকে বেতনের কপি জমা দিয়ে বের হলে রাস্তায় পথরোধ করে প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতা তাকে এক প্রকার বাধ্য করে নিজের অফিসে নিয়ে যান। মোবাইল ফোনে অধ্যক্ষের ইনসট্রাকশন অনুযায়ী উপাধ্যক্ষের সাথে থাকা ব্যাগ থেকে সোনালী ব্যাংকের দুই টি চেক ও সাদা কাগজে জোর পূর্বক স্বাক্ষর করতে বাধ্য করান সেই প্রভাবশালী নেতা।
ঐ দুইটি চেক দিয়ে উপাধ্যক্ষের একাউন্ট থেকে ৬২০০০-(বাষট্টি হাজার টাকা) উত্তোলন করে লোপাট করেন। আর সাদা কাগজের স্বাক্ষরকে পদত্যাগ পত্র বানিয়ে অধ্যক্ষ জেলা শিক্ষা অফিসার কে কৌশলে ম্যানেজ করে ফের তার বেতন বন্ধ রাখেন। অবশেষে জেলা শিক্ষা অফিসারের মধ্যস্থতায় তিন মাস পর বিষয়টি সুরাহা হয়ে উপাধ্যক্ষ আবার বেতন-ভাতা ও চাকরি ফিরে পান। ঘটনা টি ২০১৮ সালের শুরুর দিকের।
স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিকের উপাধ্যক্ষের উপর ক্ষোভের কারণ হল ,অধ্যক্ষ তার নামে স্থানীয় এমপির কাছ থেকে ডিও নিয়ে গোপনে তাকে সভাপতি করে এডহক কমিটি অনুমোদন করে নিয়ে আসেন। স্থানীয় প্রতিপক্ষরা হাইকোর্ট থেকে উক্ত কমিটির কার্যকারিতার উপর স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। অধ্যক্ষ ও তার মনোনীত সভাপতি এর জন্য উপাধ্যক্ষ কে পরোক্ষ দায়ী আখ্যায়িত করে তার বাড়ি ভিন্ন জেলায় বিধায় তার প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন। ফলে তাকে চাকরিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেন তারা উভয়।
বলাবাহুল্য, উক্ত অধ্যক্ষ মাদ্রাসার আয় আত্মসাতের দায়ে এক সময় জেলে কারাবন্দী ছিলেন এবং মাউশি কতৃক এমপিও লিস্ট থেকে তার নাম কর্তন করে অধ্যক্ষের পদ শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে। তবে, তখন ভূক্ত ভোগী উপাধ্যক্ষ সেই মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন না। উপাধ্যক্ষের জীবন ও চাকরির নিরাপত্তার বিষয়ে খেয়াল রেখে মাদ্রাসা ও তাদের নাম প্রকাশ অনুচিত মনে করছি।
এ বকম প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ কতৃক সাধারণ শিক্ষক প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। মান-সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মুখ বুজে সহ্য করেন।
এমতাবস্থায় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের প্রধানদের হাতে এই মুহূর্তে শিক্ষকদের এসিআর প্রতিবেদনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের জন্য কসাইখানাতে পরিণত হবে। তরুণ মেধাবী ও কর্মট শিক্ষকদের চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হবে।তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সাংবাদিক সম্মেলন করে ইতিমধ্যে অধিকাংশ শিক্ষক এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এবি ছিদ্দিক নামক এক শিক্ষক এর প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসিআর চালু হলে প্রথমে আমার চাকরি চলে যাবে।কারণ আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছি।আপস করা শিখি নাই ।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান(স্কূল,কলেজ ও মাদ্রাসা) সমূহে যতদিন পর্যন্ত আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত, বদলি প্রথা চালু ও প্রধানদের নিয়োগ এনটিআরসিএ তে চলে যাবেনা ততদিন পর্যন্ত এসিআর চালু করা কিছুতেই সঠিক সিদ্ধান্ত হবেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা আর্থিক সহ বিভিন্ন অনিয়মের যুক্তিসংগত প্রতিবাদ করলে প্রধানেরা তখন বর্তমান সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।তখন এসিআর অক্টোপাসের ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ৮ম পে-কমিশনের সূপারিশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের আয় সরকারি কোষাগারে জমা দান অপরিহার্য।সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন , বদলি প্রথা এবং নিয়োগ ক্ষমতা পরিচালনা কমিটির কাছ থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় এসিআর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য কসাইখানা ও মরণ ফাঁদে পরিণত হবে।
বিঃদ্রঃ মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।