
বাংলা বিয়ের একাল সেকাল। এ টি এম আশরাফুল ইসলাম সরকার রাংগা।
দাম্পত্য জীবন হচ্ছে মানবজীবনের স্বর্ণালী অধ্যায়। এর সূচনাপর্ব হলো বিবাহ। এটা কোন পুতুল খেলা নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ বিবাহকে বলা যেতে পারে- সমাজ, প্রথা, আইন, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা স্বীকৃত দুটি জীবনের আজীবন এক জীবনে সাথী হবার পবিত্র বন্ধন বা চুক্তি।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী- বিবাহ হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ইবাদত। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা বিবাহযোগ্যদের বিবাহ সম্পন্ন করো, তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছলতা দান করবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।’ (সুরা: ২৪ নুর, আয়াত: ৩২)। সুন্নত তরিকায় বিবাহ সম্পাদন বরকতময় হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: নিশ্চয় সে বিয়ে বেশি বরকতপূর্ণ হয়, যে বিয়েতে খরচ কম হয়। (মুসনাদে আহমাদ ও মুস্তাদরাকে হাকিম)। এ ছাড়া বিয়ের সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সুন্নত রয়েছে। যেমন: বিবাহ সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হওয়া; অপচয়, অপব্যয় ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতিমুক্ত হওয়া, যৌতুকের শর্ত না থাকা এবং সামর্থ্যের অধিক দেনমোহর ধার্য বা শর্ত না করা। (তাবারানি আওসাত, হাদিস নং-৩৬১২)। (আবু দাউদ: ২১০৬)।
বিবাহের ক্ষেত্রে বিন্দু ধর্মেরও কিছু শর্ত, প্রথা বা নিয়ম আছে। যেমন: পাটিপত্র, পানখিল, শঙ্খ কঙ্কন বা কন্যাকে শাঁখা পরানো, বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপবাস বা দধি মঙ্গল, গাত্রহরিদ্রা বা গায়ে হলুদ, বর বরণ, সাত পাক, বিবাহের মন্ডপে জনসমক্ষে বর ও কন্যা একে অপরের দিকে চেয়ে দেখা বা শুভদৃষ্টি, কন্যা ও বরের মালাবদল, কন্য়া সম্প্রদান, অঞ্জলি বা খৈ পোড়া এবং শেষরীতি হল- সিঁদুর দান। বিবাহের এই রীতিটি অনুযায়ী বর কন্যার কপালে সিঁদুর প্রদান করেন।হিন্দু সমাজে এখনও এই আচার অনুষ্ঠান বা প্রথাগুলো কিছুটা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য পয়সাওয়ালা ভূমি দেবতাদের কথা আলাদা। এ রকম বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, সাঁওতাল, গারো, মগ, মুরং, চাকমা, খাসিয়া সহ বিভিন্ন জাতি-উপজাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদে ভিন্ন রকম বিবাহের প্রথা আমাদের দেশে চালু আছে। এগুলোই কিন্তু আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সম্পদ।
তবে যে কোন ধর্মের দিকেই যাই না কেন; এখনকার একটা বিয়ে বাড়ি মানে নয়ন ঝলসানো আলোকসজ্জ্বা, আতশবাজির ফট ফট শব্দ, একটা ডিজিটাল ডিএসএলআর ভিডিও ক্যামেরা, আট-দশটা চক-চকে সু-সজ্জিত মাইক্রোবাস, অলঙ্কার আর পার্লারি সাজ-সজ্জার বিরাট একটা ফ্যাশন শো। বাড়িতে যেন বিয়ে নয়, বিয়ে হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে; অনলাইনে পরিচয়ের মাধ্যমে। কোন কোন সময়ে বর-বধুর সরাসরি সাক্ষাতেরও প্রয়োজন হয়না। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধোমই কবুল বলে বিয়ে জায়েজ করানো হচ্ছে। যে কয়টি বিয়ে সরাসরি বাড়িতে হচ্ছে, সেগুলোতেও আবার বধু বিদায়ে কন্যার কোন শোক নেই। হাসি-মুখে সে-ই যেন উল্টো বাবা-মাকে শান্তনা দিচ্ছে আর ক্যামেরায় পোজ দিয়ে দিয়ে ছবি তুলছে। কন্যা বিদায়ে যে মা-বাবার কোথায় লাগে তা বুঝতেও চায়না।
ছোটবেলায় আমি আমার খালা কিংবা বড় বোনদের বিয়েতে দেখেছি। বিয়ের আগে ব্যক্তিগত পছন্দের কথাটা তারা লজ্জ্বা আর ভয়ে বলতেই পারত না। বিয়ের একমাস আগে সম্মন্ধ নিয়ে চলে আসতেন ঘটক। তার কথামত কন্যার বাবা তার বড়ভাই, বড় ছেলে অথবা পাড়ার দু’একজন মান্য-গণ্য ব্যক্তিগোছের মানুষকে সাথে নিয়ে ছেলের বাড়ি দেখতে যেতেন সাইকেলে চড়ে। তাদের পড়নে কোট-প্যান্ট-টাই তো দূরের কথা সাধারন একটা ফুলপ্যান্ট পর্যন্ত ছিলনা। লাল কিংবা সাদা প্রিন্টের লুঙ্গি অথবা পাজামা পাঞ্জাবী দিয়েই চালিয়ে নিতেন। এটাই তাদের ঐ দিনটির জন্য ছিল সবোর্চ্চ সাজ-সজ্জার পোশাক। অনেকে আবার পাজামার নিচের অংশটা রুমাল অথবা শক্ত ফিতা দিয়ে বেঁধে নিতেন যাতে সাইকেলের চেইনের মধ্যে পাজামার মাথাটা ঢুকে ছিঁড়ে না যায়।
এরপর বাড়ি ও ছেলে পছন্দ হলে ছেলে (বর) পক্ষকে দাওয়াত দিয়ে আসতেন। নির্ধারিত তারিখে ছেলে পক্ষ মেয়ের বাড়িতে আসতেন কনে দেখতে। হরেক রকম নাস্তা, বাড়িতে লাগানো হাঁসে-মোরগের মাংস, গাছের লাউ, মিষ্টি কুমড়া, বাগানের সব্জি আর পুকুরের মাছ দিয়ে সাদা ভাতে আপ্যায়ণ করা হত আত্মীয়দের। খানার পর্ব সেরে উভয় পক্ষ বাহিরে এসে গোল হয়ে বসতেন চেয়ার আর বেঞ্চি নিয়ে। আমরা ছোটরা তাদের মাথার ওপর হাতপাখা ঘুরিয়ে বাতাস করতাম। মেয়ের (কনের) জন্য একটু আলাদা করে একটা চেয়ার আর হাতে নকশা করা কাপড়ে ঢাকা ছোট টেবিল পাতিয়ে রাখা হত। পানের বাটা হাতে ভাবীদের সাথে ঘোমটায় মুখ ঢেকে কনে এসে সেখানে বসতেন।
তারপর শুরু হত বরপক্ষের একের পর এক প্রশ্ন। সে পবিত্র কোর-আন শরীফ পড়তে জানে কি-না, বাংলা লেখা-পড়া কতদুর পর্যন্ত, রান্না-বান্নায় দখল কতটুকু, কোন তরকারীতে হলুদ দিতে হয়না ইত্যাদি। অনেক সময় হাত-পায়ের আঙ্গুল আর মাথার চুল বের করেও দেখতেন। আমরা ছোটরা চার-পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। মেয়ে পছন্দ হলে বরপক্ষের মুরুব্বীরা কনের সাজানো বাটার পান খেয়ে পকেট থেকে নোট বের করে বকশিস দিতেন। ছেলের বাবা দিতেন সোনার আংটি অথবা টিকলি। তারপর ঘরে বসে বিয়ের দিন তারিখ ও অন্যান্য আনুষ্ঠিকতা নিয়ে আলোচনা চলত। দেনমোহর বা গেটের প্রবেশ মূল্য নিয়ে মাঝে মাঝে তর্ক হত দু;পক্ষের মাঝে। একসময় মিটেও যেত। এভাবেই বিয়ে নিয়ে বিয়াল্লিশ কথার টক-ঝাল-মিষ্টি দিয়ে সুন্দর একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হত। এমন একটা খবর পেয়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসত কনের কিংবা কনের মায়ের কান্নার সুর। মুরুব্বীরা ধমক দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করতেন। কিন্ত এরপরেও চলত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না। কনের বোন, ভাবী সহ প্রতিবেশী মহিলারাও যোগ দিত সেই কান্নায়।
পরদিন থেকে চলত বিয়ের প্রস্তুতি। সকল আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। দাওয়াত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কয়েকজনকে আগের থেকেই ঠিক করে রাখা হত। প্রত্যেকজনকে একটা করে সাইকেল দিয়ে কে কোন দিকে যাবে তার সীমানা নির্ধারন করে দেয়া হত । ঠিক এমনি ভাবেই অর্পণ করে দেয়া হত হাট-বাজার সহ অন্যান্য সব দায়িত্বের।
পরিকল্পনা ও অর্পিত দায়িত্ব মাফিক হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে উভয় পক্ষের বিয়ের পোশাক কেনা, গেট সাজানো, নিকটবর্তী বিদ্যালয় থেকে বেঞ্চ বহন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে থালা, বাটি, গ্লাস, জগ, মগ, বালতিসহ নানাবিধ সরঞ্জামাদি সংগ্রহের কাজ চলত সমান তালে। আমাদেরও নতুন পোশাক হত বিয়ে উপলক্ষে।
বিয়ের আগের দিন কলাগাছ আর বাঁশের চ্যাপলা দিয়ে তৈরী করা হত বিয়ের গেট। গেট সাজানো হত রঙিন কাগজে নকশা কেটে কেটে। বাড়ি সাজানো হতে দড়িতে আঠা দিয়ে লাগানো বিভিন্ন রকম কাগজ আর ছোট ছোট বাঁশের খুঁটি দিয়ে। এখনকার দিনে স্বাধীনতা দিবস অথবা বিজয় দিবসে যেভাবে পতাকার চারদিকে দড়ি আর কাগজ দিয়ে চারিপাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়, ঠিক সেরকম করে। সবাই যার যার কাজে চরম ব্যস্ত।
অপরদিকে ঐ দিনেই পাড়ার সকলে মিলে কনের গায়ে হলুদের ব্যবস্থা করতেন। চারদিকে চারটি কলাগাছ পুঁতে তার তিন পাশ কাপড় দিয়ে ঘিরে মাঝখানে বিছানোর চাদরে কোলে করে নিয়ে বসানো হত কন্যাকে। জমি থেকে তুলে আনা কাঁচা হলুদ শিলপাটায় পিষে তার রস লাগানো হত কনের মুখে। সে ক্ষেত্রে বাড়ির মুরুব্বীদের দ্বারা উদ্বোধন করা হত এ পর্বটি। পরে এক এক করে সবার গালে-মুখে এই হলুদ জোর করে মেখে দিয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন আইও-মাইওরা (কনের সখীরা)। বিশেষ করে কনের দুলাভাইয়েরা তো মোটেও রেহাই পেতেন না এই এলাহী কাণ্ড থেকে।
অনেক সময় তাদের কাছ থেকে দাবী করে টাকাও আদায় করতেন ঐসব সখীরা। তাকে নিয়েই কলাগাছের চারপাশ ঘিরে গ্রামের মহিলারা গীত-আনন্দে বিভোর হয়ে যেতেন। কনের প্রতিবেশী অন্যান্য নানী দাদীরা বৃদ্ধ, তবুও ভাবী অথবা কুমারী মেয়েদের সাথে তারা কোমর দুলিয়ে নাচতেন আর মজা করতেন। আমরা মাঝে-মধ্যে নাচের স্থানগুলোতে পানি ঢেলে দিয়ে পথটাকে পিছল করে দিয়ে দৌড়ে পালাতাম। মুখে বাজত বর্তমান গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই পুরাতন গীত- ‘কন্যার কাঁই (কে) আছে দরদী, কাঁই মাখিবে হলোদি (হলুদ>হলদি>হলোদি) কিংবা ঝড়ি পড়ে ছিপরে ছিপো, আঙিনা হইছে মোর পিছিলা রে.. রসিয়া’। এরুপ হাসি-কান্না আর বাংলার গ্রমিীণ জনপদের সুখ কিংবা দু:খের জীবনগাঁথা নিয়ে রচিত গীত-নৃত্যের তালে গায়ে হলুদের পর্ব শেষ গয়ে যেত।
এরপর শুরু হত ফোরন ডোবানোর পর্ব। চাইলোনে করে কয়েকটি ছোট মাটির পাত্রে সরিষার তেলে ভরিয়ে সেখানে চুবিয়ে রাখা কাপড়ের তৈরী সলতের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে পুকুর অথবা নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হত। এটাকেই বলা হত বিয়ের ফোরন ডুবানো। এখানেও চলত সমবেত কণ্ঠে বিয়ের আনন্দ-বিচ্ছেদের নানান রকম গীত। যেমন, ‘জ্বলুক জ্বলুক রে বাতি- আজিকারও রাতি, রাতি পোহাইলে রে হবে- মায়ের কোলও খালি’…এভাবে বাবা, ভাই বোনসহ কনের সকল আপনজনের কথা গীতের মাধ্যমে এক এক করে উল্লেখ করে চোখ দিয়ে কষ্টের পানি ঝড়াতেন। এ পানি পেঁয়াজের রস কিংবা গ্লিসারিনের নয়, এ পানি গাঁয়ের কিছু মানুষের মেয়ে হারানোর সত্যের ধারা।
অবশেষে রিকশায় কিংবা গরুর গাড়িতে চলে আসত বর। একটা সাদা-মাটা চৌকির ওপর কোল বালিশে ঠেস দিয়ে বসানো হত তাকে। বিয়ের লগ্নে দু-তিন জন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে গুড় মিঠাইয়ের দাওয়াত দিয়ে আসত। সকলের উপসিস্থিতিতে মৌলভী সাহেব শরিয়াহ্ অনুযায়ী বিবাহ কার্য সম্পন্ন করতেন।
এদিকে কনের ভাবীরা আগের থেকেই বর-বধূকে বোকা বানানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে রাখতেন। পাশা খেলা, পয়সা লুকানো, বরের খাবারে লবণ-ঝাল বেশি করে দেয়া ইত্যাদি। এগুলো যেন পর্বই শুধু নয়, বরের জন্য এক-একটি পরীক্ষাও বটে! এসব পর্বে বরকে একেবারে নাকানি-চুবানি করে ফেলতেন। এতকিছুর পরেও যেন কোনই অভিযোগ নেই।
সকল পর্ব শেষ হলে শুরু হত সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটির দৃশ্য। বধু বিদায়। বরের পাঞ্জাবীর সাথে বধূর লাল শাড়ির আঁচলটি যখন বেঁধে দেয়া হত, তখন থেকেই সুর উঠত কান্না-কাটির। মা-বাবা তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরিয়ে কাঁদছেন। ভাই তার বোনকে জড়িয়ে ধরে কষ্টের পানি ছেড়ে দিচ্ছেন। প্রতিবেশীরাও যেন চোখ মোছা থেকে বাদ পড়ছেন না। তাদের এই কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। গাড়ি রাস্তায় উঠেছে, এরপরেও শোনা যায় নববধূর সেই করুণ কান্নার কলজে ফালা ফালা করা শব্দ। একসময় সব কিছুই নীরব হয়ে যেত। নিভে যেত হ্যাজাক লাইটের আলো।
বিয়ের দুই বা একদিন পর এবার বিয়ে ফেরানোর পালা (কনেকে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আনা)। বাড়ির কর্তার কথা, কমপক্ষে দশটা গরুর গাড়ি করতে হবে বিয়েতে। তাই গাড়ি ভাড়া করার জন্য নিজস্ব গাড়িয়াল আদিষ্ট হয়ে পাড়া বা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সে সব গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে বেড়িয়ে পড়তেন। বিয়ে আনার দিন যথাসময়ে দশখানা গরুর গাড়ি এসে হাজির হত। সাথে দুটো মাইক। সবাই যথাসম্ভব সাজ-গোজ করে যার যার বির্ধারিত গাড়িতে উঠে পড়ত। গরুর গাড়ি ছইয়ে ঢাকা। এরপরেও মুরুব্বীদের নির্দেশ- ছইয়ের সামনে ও পেছনে যে অংশটা ফাঁকা, তা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে নিতে হবে। কোনমতেই যেন বাহিরের কোন মানুষ মেয়েদেরকে দেখতে না পায়।
আমরা মাইক ওয়ালা গাড়িতেই উঠে পড়তাম। কারণ ঐ গাড়িটার ছইয়ের দু’পাশ ফাঁকা থাকত। তাই প্রাণ ভরে নি:শ্বাস নিতে পারতাম। সারিবদ্ধ হয়ে গাড়ি গুলো বিয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে অনেকেই মুখ দিয়ে বাজাত তবলা আর দোতরায় ভাওয়াইয়ার সুর। ওদের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ঢঙ্গে আমরাও গান গাইতে শুরু করতাম। মাঝে মাঝে গাড়িয়াল ভাইও আদের সাথে গলার যোগান দিতেন। পরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কলের গানে (গ্রামোফোন রেকর্ড) বাজত বিয়ের গীত আর গ্রাম-বাংলার সেই চিরায়ত আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম, নীনা হামিদের গান সহ কিচ্ছা-কাহিনী। মাইকের মাইক্রোফোনের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে যেত অনেক দূর। গীত-নৃত্য-বাদ্যের তালে তালে বিয়ে নিয়ে ফিরতে রাত ভোর হয়ে যেত।
এখনও বাংলাদেশের কিছু কিছু গ্রামে বিবাহের এসব ঐতিহ্য রক্ষা করা হলেও কালের গর্ভে বিলীন হতে চলেছে বাংলার মূল ধারার সকল সংস্কৃতি। শুধু বিয়ে নয়, আশির দশকের এ বিষয়টাকে আমি স্বল্প পরিসরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করিয়েছি কালের সাক্ষী হিসেবে মাত্র। অথচ আমরা বুঝতেও পারছিনা, বিয়ের সাথে সাথে আলগা করাতে বসেছি আমাদের ঐতিহ্যের শেকড়টাকেও।
যূগের পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। যূগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষের মানসিক ও জীবন-জীবিকার ধরনও পাল্টাচ্ছে। বিজ্ঞানের ছোঁয়া পেয়ে মানুষ হয়ে গেছে যান্ত্রিক ও কর্মব্যস্ত। এক-একটা করে দিন অতিবাহিত হচ্ছে আর রুপ কথার সেই দাদী-নানীর গল্পে পরিণত হচ্ছে। এটাকে মেনে নিতেই হবে। আমিও এর পক্ষে। কিন্তু কোন দেশের নিজস্ব ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে পছেনে ঠেলে দিয়ে এ ধরনের পরিবর্তন আমি মোটেও প্রত্যাশা করিনা। বিশ্বের অন্যান্য রাস্ট্রগুলো তাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে তো বটেই; উপরন্তু নিজেরগুলোকেও ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের দরবারে। আমরা বিশ্বে ছড়িয়ে না দিতে পারি, অন্তত: নিজের শেকড়টাকে তো আঁকড়ে ধরে থাকতে পারি। এ দায়িত্ব আমাদের সকলের। নইলে দেশ আমাদের কাউকেই ক্ষমা করবেনা। এর ফল একদিন ভোগাবেই। আসুন, সবাই মিলে আমাদের নিজস্ব এই সম্পদগুলোকে সংরক্ষণ করার শপথ করি। এখনও সময় আছে নিজের দেশের ঐতিহ্যগুলোকে টিকিয়ে রাখার।