বঞ্চনা ও অব্যবস্থাপনার অপর নাম বেসরকারি শিক্ষা

প্রকাশিত: ১১:৪৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৪, ২০২০

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার মূল চালিকাশক্তি। কেননা প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার সজ্ঞা ও পরিচিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর উচ্চ শিক্ষা বিষয়ভিত্তিক ও বিশেষায়িত শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে। বিশেষ জ্ঞান বিতরণ করে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষাই সামগ্রিক শিক্ষার কেন্দ্র। এই মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়েই আমার আজকের লিখা।

শিক্ষকতা পেশায় কারও কাছ থেকে পরিপূর্ণ ফলাফল ও পেশাদারিত্ব পেতে হলে, ঐ পেশার নিয়ম-নীতি, পদোন্নতি, সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থিক নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি সামাজিক মর্যাদার প্রয়োজনীয় সংস্থান একান্ত প্রয়োজন। এগুলোর ব্যবস্থা করার পর তার কাছ থেকে ফলাফল ও পেশাদারিত্ব আশা করতে পারেন। অন্যথায়, তার কাছ থেকে পরিপূর্ণ প্রত্যাশা ও আচরণ পাবেন না। উল্লেখিত ব্যবস্থা গুলি আমাদের প্রচলিত বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে একবার বিশ্লেষণ করি।
যদিও বর্তমান সরকারের আমলে মাধ্যমিক শিক্ষায় কিছুটা গতি বা প্রাণ সঞ্চার হলেও যতটুকু দরকার তা থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বর্তমান অবস্থা একবার মিলিয়ে নেই।

প্রথমে বলি, Professionalism বা পেশাদারিত্ব কি?
মানুষের ছোট বড় গুনগুলো ও নিজের প্রতিষ্ঠানের নিয়ম নীতি গুলো একসূত্রে মালা গেথে নিজের পেশায় ব্যবহার করতে পারার নামই পেশা দায়িত্ব।

দ্বিতীয়ত:- নিয়ম-নীতির কথা বলতে গেলে অগোছালো ও সময়ে সময়ে কিছু পরিপত্র দ্বারা সম্পূর্ণ বেসরকারি শিক্ষা পরিচালিত। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষা নীতি তৈরি হয়, তৈরি হয় শিক্ষার পরিপূর্ণ আইন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আইন বা নীতি যা তৈরি হয়, তা বাস্তবায়ন হয়না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যতটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, তাদের সবাই সুপারিশও করেছে। কিন্তু কোনটিঈ পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতির ব্যাপারে তাই বলা যায়। কোনটি সিকিভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে আবার কোনটি আলোর মুখও দেখেনি।

তৃতীয়ত:- পদোন্নতির ব্যাপারে চরম উদাসীনতা, খাপছাড়া ও নিয়ম-নীতিহীন এক নৈরাজ্য বিদ্যমান। সময়ে সময়ে পরিপত্র দিয়ে একেক ধরনের নিয়ম বলা হয়, যা অনেক সময় মুল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে চলে যায়। তার পরে আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
যেমন:- বিএড ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করলে বেতন ১১ নম্নর কোডে দেয়া হয়, বিএড করার পর ১০ নম্বর বেতন কোডে। আর উপরে যাওয়ার উপায় নাই। অন্যদিকে বিএড সহ শিক্ষকতা পেশায় আসলে ১০ নম্বর কোডে বেতন দেয়া হয়। তারপর ১০ বছর সফলভাবে পেশাদারিত্বের পর টাইম স্কেল নিয়ে ৯ নম্বর কোডে বেতন পান।
কিন্তু বিএড ছাড়া যারা শিক্ষকতায় এসেছেন তারা কোন দিন ৯ নম্বর বেতন কোডে যেতে পারবেন না। এটা চরম অনিয়ম ও পেশাদারিত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন মাত্র।
আবার সরকারি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ৬ নম্বর বেতন কোড পান, কিন্তু বেসরকারি প্রধান শিক্ষকগণ তা পান না। এটা চরম অনিয়মের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

চতুর্থত:- সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও খুবই নাজুক। এই বিষয়টি এত নাজুক যে, বিধিমোতাবেক শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যে কোন প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকগণ কর্মরত থাকেন। তাদের পরিচালনার জন্য ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বার ছাড়া একটি কমিটি থাকে। এই কমিটি হাই স্কুলটি সম্পূর্ণ পরিচালনা করে। এর ফলে অনেক ঘটনাই ঘটে, যা শিক্ষকগণ নিজ গুনে হজম করে নেন। কোন কোন ক্ষেত্রে এইসব বিষয় বেরিয়েও আসে, যখন শিক্ষা পরিবারের বাইরের লোক এসব জেনে যায় বা দেখে ফেলে। এমনও ঘটে, শিক্ষকগণ তার ছাত্রদের শাসনের জন্য যে শাস্তি শিক্ষার্থীকে দিলে তার পেশা চলে যায়, সেই শাস্তির অনেক গুণ বেশি শাস্তি দিয়েও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সদস্যপদ যায় না। আর কিছু কি বলার প্রয়োজন আছে?

পঞ্চমত:- আর্থিক নিরাপত্তার বেহাল দশা। এখানে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। একটা পরিবার ভরণ-পোষণের জন্য যে আর্থিক সংস্থান প্রয়োজন, তার কোন নিশ্চয়তা এই মাধ্যমিক শিক্ষকের বা এমপিও ভুক্ত শিক্ষকের পেশায় নেই। বেতনের শুধু মাত্র স্কেল প্রদান করা হয়। বাড়ি ভাড়া মাত্র ১০০০/০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ৫০০/০০ টাকা। হিন্দু- মুসলিম সকলে দুই ঈদে স্কেলের ২৫% ঈদ বোনাস। অনেক চেষ্টা ও আন্দোলনের ফলে ২০% বৈশাখী ভাতা। অন্য কোন আর্থিক সুবিধা নাই। যেমন, ১১ নম্বর বেতন কোডে যিনি চাকুরী করেন তার সর্বমোট বেতন হবে ১২৫০০/০০ +১০০০/০০ +৫০০/০০ = ১৪০০০/০০ টাকা। এর থেকে কর্তন হবে ১০% কল্যাণ অবসর জন্য কেটে নেয়া হয়। অন্য দিকে যে কোন সরকারি হাই স্কুলে বা সরকারি চাকুরীতে সম বেতন কোডে পান ১২৫০০/০০ + বাড়ি ভাড়া বেতন স্কেলের ৪৫% + চিকিৎসা ভাতা ১৫০০/০০ + দুই সন্তানের শিক্ষা ভাতা + বিনোদন ভাতা + বোনাস দুই ঈদে দুই বেসিক, বেসিকের ২০% বৈশাখী ভাতা। তাছাড়া ইনক্রিমেন্ট তো আছেই। কিছুটা হলেও বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৮ খ্রি: থেকে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্ট দেয়ায় বৈষম্য কিঞ্চিত হলেও কমেছে।
এই হিসাবে সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক যে বেতন গ্রহণ করেন, তার অর্ধেকের অনেক কম বেতন গ্রহণ করেন বেসরকারি শিক্ষকগণ।
৬ঠত, সামাজিক মর্যাদার বিষয়ে বলতে গেলে স্বাভাবিক ভাবে বলা যায়, আপনার আচরণ, ব্যক্তিত্ব, কাজের প্রতি একাগ্রতা ও পেশাদারিত্বের উপর সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করে। কিন্তু এখানে অন্য ভাবে আমি বলি, প্রতিটি মানুষের নিজের স্বার্থে আঘাত হলেই সে মরিয়া হয়ে উটে তার স্বার্থ উদ্ধারে। বিপত্তি ঘটে এই জায়গায়। কমিটি যেহেতু সমুদয় বিষয় দেখা শোনা করে, তাই ব্যক্তি পর্যায়ে হোক আর গ্রুপ পর্যায়ে হোক কার কোন অসুবিধা দেখা দিলেই কমিটি যেন তেন ভাবে তাদের স্বার্থ হাসিলে মরিয়া হয়ে উঠে। এখানে নিয়ম কানুন বা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় গৌণ হয়ে যায়। খেলার পুতুল হয়ে যান শিক্ষকগণ।

সার্বিকভাবে বলা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে শাসন করার মানুষের অভাব নাই। কিন্তু এই বিশাল শাখা সুন্দর একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। বলা হবে, এমন যদি অবস্থা হয় তাহলে, মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষা এই পর্যায়ে আসল কীভাবে। উত্তর হল, যখন যে সমস্যা সৃষ্ট হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষকদের আহাজারি ও চরম আর্তনাদে নতুন পরিপত্র ও শিক্ষানীতি হাতড়িয়ে সমাধান এসেছে। কেউ স্বেচ্ছায় সুন্দরের স্বার্থে বা দেশ গড়ার লক্ষে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যদি কারণ জানতে চান, তবে বলি, মাধ্যমিক পর্যায় দেখ-ভাল করেন প্রায় সকলেই কলেজ শিক্ষক। তাই মাধ্যমিক পর্যায় নিয়ে তারা এত ঘাটাঘাটি করতে নারাজ। এগুলোর সমাধানের জন্য আলাদা মাধ্যমিক অধিদপ্তর স্থাপন করে মাঠ পর্যায় থেকে কর্মকর্তা নিয়োগ দিলেই মনে হয় একটা সুরাহা হবে।
সেই ভাল ও সুন্দরের অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক:- মো: জালাল উদ্দিন
সহসভাপতি
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম,

প্রধান শিক্ষক
খাজার মোকাম উচ্চ বিদ্যালয়
সিলেট।


Categories