“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : সম্মোহনী নেতৃত্বের এক প্রতিমূর্তি”

প্রকাশিত: ১:৪২ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৪, ২০২০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব :  সম্মোহনী নেতৃত্বের এক প্রতিমূর্তি।   মৃধা আহমাদুল কামাল

প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী, ম্যাক্স ওয়েবার তিন ধরনের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্বের কথা বলেছেন তাঁর, The Theory of social and Economics Organisation গ্রন্থে। এই কর্তৃত্ব বা নেতৃত্বের ধরনগুলো নিম্নরূপ :১

আইনসিদ্ধ কর্তৃত্ব: ( Rational leagal authority) এরূপ কর্তৃত্বের ভিত্তি হলো আইনগত কাঠামো যা পদসোপানিক
ক্ষমতাকে বুঝায়। এর আদেশ হলো  নৈর্ব্যক্তিক এবং সুস্পষ্ট আইন দ্বারা অফিস পরিসরে সীমাবদ্ধ, যেমন আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব যা পদাধিকার ও আইনানুগ আদেশ নির্ভর।

ঐতিহ্যগত বা সনাতন কর্তৃত্ব : (Traditional authority) এ-ধরনের কর্তৃত্বের উৎস  হচ্ছে উত্তরাধিকারতন্ত্র। কোন একটি পরিবার বা বংশের প্রতি বিশ্বাস এবং সনাতন রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব। এখানে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য নৈর্ব্যক্তিক নয় বরং বিশেষ ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। বৃটেনের নিয়মতান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ঐতিহ্যগত কর্তৃত্বের উদাহরণ।

সম্মোহনী বা আকর্ষক কর্তৃত্ব : (Charismatic authority) অসামান্য গুণাবলীর অধিকারী, আকর্ষণীয় মনোভঙ্গি, বীরোচিত, অনুকরণীয় চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততার বলে এ-প্রকার নেতৃত্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজবিজ্ঞানী আলী আশরাফ ও এল এন শর্মা, তাঁদের Political Sociology: A grammar of new politics গ্রন্থে, সম্মোহনী নেতৃত্বের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,    “Charismatic authority  is inherent in outstanding individuals are rare leaders generally produced in time of crisis”২
এ-ধরনের নেতৃত্ব সমর্থককুলের মননে এমন গভীর প্রত্যয়, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের জন্ম দেন যে, অনুসারিগণ মনে করেন, তাদের নেতা ভুল করতে পারেন না। তিনি একটি জনসমাজ বা গোষ্ঠীর একচ্ছত্র প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পান।৩  ইতিহাসে এরূপ নেতৃত্বের সংখ্যা খুব বেশি নেই। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, মাও সে তুং, জর্জ ওয়াশিংটন, চার্চিল, আব্রাহাম লিংকন, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সর্বাগ্রে  উচ্চারণযোগ্য। এসব নেতা জাতীয় সঙ্কটকালে মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হন।

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে এসেছিলেন এমন এক অনিরুদ্ধ, অনির্বাণ ব্যক্তিত্ব যাঁর অলোকসামান্য সম্মোহনী নেতৃত্বেসমগ্র বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ একটি লক্ষ্য অর্জনে যুথবদ্ধ হয়েছিলো। বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে যখন তমসাচ্ছন্ন ‘বিদিশার নিশা’ এ-জনপদের প্রতিটি প্রাণ যখন দিশাহীন পথের যাত্রী। পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক চক্রের ষঢ়যন্ত্র আর শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে জাতির জীবন-জীবিকার ঝুলি যখন কপর্দকশূন্য, এমনি এক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অত্যন্তসতর্কতার সাথে সুপরিকল্পিত উপায়ে, নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রেখে, একজন সুদক্ষ কুশলী খেলোয়াড়ের মতো গেম থিওরি এপ্লাই করে, একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রদান করে ধীর পায়ে এগিয়ে যান স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতার পথে। এই বাংলার রাজনৈতিক মল্লভূমে  (Political arena) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আবির্ভাব এক অভিনব ও যুগান্তকারী ঘটনা তাঁরগণমনোহারি ক্যারিশমা এতটাই প্রবল প্রভাবক ছিল যে, তিনি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে জনতাকে বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে পাকিস্তান এদেশেরই মুসলিম নেতা-জনতা, ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় প্রতিষ্ঠা করেছিলো।৪ সেই পাকিস্তাানের ভিত চুরমার করে দিয়েছিলেন ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের মাধ্যমে- যে শ্লোগান তৎকালীন গণমানুষের প্রাণের শ্লোগানে পরিণত হয়। আজ বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন যে যেভাবেই করুন না কেন, আমাদের যে শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘স্বাধীনতা’ তা এদেশের জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরই শ্রান্তিহীন সংগ্রামের ফসল। আর এ অর্জন সম্ভব হয়েছিলো তাঁর যুগোপযোগী সম্মোহনী নেতৃত্বের বল।বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বের সমর্থন পাওয়া যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহানের, Bangladesh Politics: Problems and issues গ্রন্থে। তিনি বলেন,  “By all accounts Sheikh Mujibur Rahman was a charismatic figure in 1970“৫  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন ছাত্র নেতা হিসেবে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিমলীগের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তাঁর প্রাথমিক জীবন অতিবাহিত করেন সংগঠনিক কাজে। ১৯৪৯  সালে যখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ছিলেন এর প্রথম যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বয়স ছিল তখন ঊনত্রিশ বছর। তিন বৎসর পর তিনি এ-দলের সাধারণ সম্পাদক হন।। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দপ্তরের মন্ত্রী হন। কিন্তু পরে তিনি পার্লামেন্টারি দলের নেতা না হয়ে মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজ দল আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের  সদস্য নির্বচিত হন। ১৯৬০ সালের দিকে তিনি সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব থেকে আকর্ষক নেতৃত্বে রূপান্তরিত হতে থাকেন। এ-প্রসঙ্গে  রওনক জাহান বলেন, Mujib’s metamorphosis from an organization man to a charismatic leader came in 1960’s ৬   ১৯৬৩ সালে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরলোকগমনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগতে থাকে। এমতাবস্থায়, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে পুনঃর্গঠিত ও উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালান এবং কার্যত  দলের নেতৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগে তাঁর নেতৃত্ব সুসংহত করে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন শুরু  করেন, যা আওয়ামী লীগকে নিয়ে আসে পাদপ্রদীপের আলোয় আর তিনি নিজে পরিণত হন ছয় দফার একজন জনপ্রিয় প্রবক্তায়  এবং ছয়দফা ছিল বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বে পরিণত হওয়ার টার্নিং পয়েন্ট। ছয়দফা আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্যে, তাঁর অনুপম  রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিনাস করার জন্যে, সামরিক জান্তা আয়ূব সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বিরুদ্ধে আগরতলা  ষঢ়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তাঁকে করারুদ্ধ করে রাখে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন এতে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে একেবারে তুঙ্গে উঠে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আয়ূব সরকার। তখন রমনা রেসকোর্সে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিশাল গণ-সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং তাকে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। এ-সময় তিনি অনন্যসাধারণ নেতায় পরিণত হন এমনকি তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগঠন আওয়ামী লীগকেও ছাড়িয়ে যান। অধ্যাপক রওনক জাহানের ভাষায়, ” ‘By early 1969 when Mujib was freed from prison and was welcomed in Dhaka by an unprecedented show of popular support, he stood well above the other leaders and even above his own party.”7

সত্তরের নির্বাচনে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল ১৬৭টি আসন অধিকার করে যে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেনতাতে তাঁর নেতৃত্ব প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং তিনি গণ্য হন পূর্ব বাংলার একচ্ছত্র, অপ্রতিরোধ্য ও অসমান্তরাল নেতা হিসেবে। ১৯৭১ সালের ৭মার্চের ভাষণ তাঁর জীবনের আরেক অন্যন্য কৃতি। এ-ভাষণের মধ্যদিয়ে তিনি হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির এক মহানায়ক- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এ-ভাষণের প্রতিটি বাক্য বাংলার মানুষ শুনেছে, শুনছে এবং অনাগত কালে শুনবে সম্মোহিতের মতো কান পেতে আর উজ্জীবিত হবে দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায়। এই জ্বালাময়ী সূর্যমুখী বাণী-ঝংকার প্রতিটি শ্রোতার রক্ত-কণিকায় নাচন তোলে, দেশাত্মবোধের অমিয়ধারায় অবগাহিত করে, ‘জন্মভূমি রক্ষাহেতু’ মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে আত্মবলিদানে প্রেরণা যোগায়।

স্বাধীনতাত্তরকালে শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শাসনশইলী একেবারে নিখুঁত হবার কথা নয়। পৃথিবীর কোন শাসন ব্যবস্থাই একচ্ছত্র ভাবে ত্রুটিবিহীন নয়। তদোপরি একটি সদ্য স্বাধীনকৃত, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের শাসনকার্য সুচারুরূপে পরিচালনা করা বাস্তবিকই একটি দুরূহ কাজ। এ-ধরনের নব্য স্বাধীনকৃত রাষ্ট্রে জনগণের প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী। ফলে আশা-প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ভারসাম্য রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। এর অবশ্য একটা তাত্তিক কারণ রয়েছে। এসব রাষ্ট্রে যখন ঔপনিবেশিক শাসন চলে, তখন স্বদেশী নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে এশিয়ায়, মুক্তির পথ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জনকে ‘’প্যানেসিয়া ((Panacea) বা ‘সর্বরোগ পরিহারক বটিকা’ হিসেবে ধারণা দেন।৮  ফলে স্বাধীনতা অর্জিত হলেই সকল আশা-প্রত্যাশা পূরণ হয়ে যাবে মর্মে জনগণের মনোজগতে উচ্চাশা পূরণজনিত একটা বিপ্লব ঘটে ( Revolution of rising expectation )। কিন্তু , স্বাধীনতা অর্জনের পর, সরকারি কর্মকাণ্ডে যখন জনগণের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়, তখন তাদের প্রত্যাশা বা চাহিদার তুলনায় যথাযথ যোগান দেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনা। তখনই শুরু হয় উচ্চাশার শিখর থেকে ‘স্বর্গপতন’ (‘Paradise lost’)। এমতাবস্থায়, জনমনে একটা হতাশাব্যাঞ্জক বিপ্লব ( Revolution of rising frustration ) দেখা দেয়। আর তখনই প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকার বেদনায় নীল হয়ে নেতৃত্বের উপর আস্থা হারান। আমাদের বাংলাদেশেও এ-তত্তের ব্যত্যয় ঘটেনি। তাছাড়া বাংলাদেশকে নিয়ে ছিলো জাতীয়আন্তর্জাতিক নানা ষঢ়যন্ত্র। শেখ মুজিব সরকারকে তৎকালে ব্যর্থ করার ছিলো বহুমুখী প্রয়াস। তাই শাসক বঙ্গবন্ধুর উপর ব্যর্থতার দায় দিলে এটা হবে আরেকটি বড় ভুল। মওদুদ আহমদের বহুল আলোচিত, ‘বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ গ্রন্থে বলেন, “এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তিনি একজন যোগ্য প্রশাসক ছিলেন না কিংবা সরকার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলেন।”৯  তারপরও বলা যায় যে শাসক মুজিবের সমালোচনা থাকা অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ সমালোচনাহীন কোন শাসনব্যবস্থা বিশ্বের বুকে আছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু সম্মোহনী নেতা মুজিবকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। বাঙালির জন্য তাঁর অবদান অনন্তকাল অম্লান হয়ে থাকবে। তাঁর ঋজু বরাভয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রেরণার উৎস হিসেবে সঞ্চারিত হতে থাকবে। বাংলার ইতিহাসে তাঁর অবস্থান মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো প্রখর, প্রদীপ্ত-প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মওদুদ আহমদ বলেন, “তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর সমাধি রচিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি রূপকথার নায়কের মতই ভাস্কর হয়ে থাকবেন। . . . . . শেখ মুজিব ছিলেন সেই ব্যক্তি জীবনব্যাপী যিনি এই জাতির স্বার্থে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। বিরাজ করেছিলেন এ-জাতির আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হিসেবে। তিনি ছিলেন সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক যা এক সর্বব্যাপী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সোপান রচনা করে দিয়েছিলো। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যতই পরিবর্তন আসুক না কেন আর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পটপরিবর্তনের যত লীলা খেলাই চলুক না কেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধানতম নেতার আসন থেকে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্ন করা যাবেনা।সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, নব্য- মৌলবাদ যেটাই বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোতে ভিত গড়ে বসুক না কেন বা এদেশে বিপ্লবী বা প্রতিক্রিয়াশীল সরকারই ক্ষমতায় আরোহণ করুন না কেন স্বাধীন  সার্বভৌম বাংলাদেশ শেখ মুজিবের কীর্তি হিসেবে চিরদিন ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে।”১০

দু-হাজার চার সালে বিবিসি বাংলার এক শ্রোতা-জরিপ হয়। বিষয় ছিলো ‘সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি কে?’ ত্রিশ দিনব্যাপী চালানো জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে, বিশজন নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্য থেকে জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে মনোনীত করা হয়- ১১ যা ছিলো এক যথার্থ ও যৌক্তিক প্রয়াস। কারণ, খেলার মাঠে যিনি চূড়ান্তভাবে গোল দেন তিনিই শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গণ্য হন। বাঙালির যে প্রধানতম প্রত্যাশা ও অর্জন তা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। তবে, তার মানে এই নয় যে, আর  নেতৃবৃন্দের অবদান অস্বীকৃত হচ্ছে। যাঁর যে অবদান তা ইতিহাস থেকে কখনো মুছে যাবেনা। তা, ইতিহাস বিকৃতির যত চেষ্টাই চলানো হোক না কেন।

একবার প্রখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্ণাড’শ জিঞ্জাসিত হয়েছিলেন, ‘আপনি বড়ো না শেক্স পিয়র বড়ো ? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমিই বড়ো, কারণ আমি তাঁর ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছি।’ বঙ্গবন্ধুই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কারণ, তিনি তাঁর অন্যান্য
পূর্বসূরীদের নিবিড় সাহচর্য পেয়েছিলেন এবং দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের গড়া উঁচু ভিতের উপর, দেখেছিলেন বহুদূর পর্যন্ত, বহু কষ্টেসৃষ্টে, অতুল সাধনায় বঙ্গবন্ধু নিজেকে পরিণত করেছিলেন অনন্য এক শিখরচূড় উচ্চতাসম্পন্ন এক সম্মোহনী নেতৃত্বের
প্রতিমূর্তিতে এবং অপরিমেয় দূরদর্শিতায় পৌঁছুতে পেরেছিলেন ইপ্সিত গন্তব্যে।

অধ্যক্ষ, সরাইল সরকারি কলেজ, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

তথ্যসূত্র :
১. Eric Nordilinger, Politics and Sociology (Studies in Comparative Political Sociology), 1970,p,- 35-40
২. Ali Ashraf, L. N. Sharma: Political Sociology, a new grammer of politics, 1983, p, 108
৩. এম. শামসুর রহমান: আধুনিক লোকপ্রশাসন, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩, পৃ,৩৪৫
৪. শেখ মুজিবুর রহমান : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড-২০১২, পৃষ্ঠা: ২২-৩৮
আবুল মনসুর আহমদ : শেরেবাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু, আহমদ পাবলিশিং হাউস-১৯৮১, পৃষ্ঠা : ৮-৯
৫. Rounaq Jahan : Bangladesh Politics : Problems and Issues. New Expanded Edition-2005, Fourth Impression
2017, P.41

৬. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: চ.৪১     ৭. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: চ.৪১

৮ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: ১
৯. মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল চতুর্থ মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, পৃ: ৩৬০
১০. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: ৩৫৮

১১. ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ ইন্টারনেট দ্রষ্টব্য


Categories