দেশের উন্নয়ন এবং আমাদের শিক্ষা উন্নয়ন ভাবনা

প্রকাশিত: ৯:৩১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩১, ২০২০

সবুজ হাসান, বাগেরহাট:

 সত্তরের দশকের বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ সেখানে নেই। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সামনে এগিয়েছে, উন্নতি হয়েছে। তবে সেই উন্নতিটা কেমন হয়েছে, তার একটি উদাহরন ছোট এই গল্পে দিচ্ছি। একজন লোক একটা ভাঙ্গা থালা হাতে নিয়ে রাস্তার মোড়ে ভিক্ষা করতো। ধীরে ধীরে টাকা জমল। এর পরে একটা প্লাস্টিকের থালা কিনল। আরো ভিক্ষা করে আরো কয়েকদিন পরে একটা স্টিলের থালা কিনল। এভাবে ভিক্ষা চলতে লাগল আর লোকটির হাতের থালাটা উন্নত হতে লাগল । তার হাতে এলো মেলামাইনের থালা, সিরামিকের থালা, রুপার থালা, সর্বশেষে স্বর্নের থালা। এখন সে স্বর্নের থালা হাতে নিয়ে ভিক্ষা করে। তার আশা আছে ভবিষ্যতে একটি হীরার থালা কিনবে। তা না পারলে স্বর্ণের এই থালাটিতে অন্তত হীরার কারুকাজ করাবে। থালার যতই উন্নতি হোক, ভিক্ষা বন্ধ হবে না।

উন্নত দেশ বলতে আমরা আসলে কি বুঝি? আমি একটা দেশের নাম বললে, সাথে সাথে আপনারা বলতে পারবেন সেটা উন্নত দেশ কিনা। কিন্তু কী দেখে ওই দেশগুলোকে উন্নত বলেন? কী থাকলে একটি দেশকে উন্নত বলা যায়? উন্নত দেশ সম্পর্কে আমাদের ধারনা তিনটি জিনিসে সীমাবদ্ধ। সেগুলো হল বস্তা ভরা টাকা, উঁচু উঁচু বিল্ডিং ও চকচকে রাস্তা। মজার ব্যাপার এই তিনটির কোনটিই উন্নত দেশের লক্ষণ নয়।

ইউরোপ আমেরিকা থেকে বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার ছুটে আসেন মধ্যেপ্রাচ্যে বেশী বেতনে কাজ করার জন্য। এসব দেশে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বেতনের চাকুরী। রয়েছে সবচেয়ে দামি বাড়ী, হোটেল, বিল্ডিং ও গাড়ী। রয়েছে চকচকে রাস্তা ঘাট। কোন কিছুরই কমতি নেই এই দেশগুলিতে। সবকিছুতেই তারা সেরা। এর পরেও সেরা দশটি উন্নত দেশের তালিকাতে এদের পাওয়া যায় না। এর একটাই কারণ – ওখানে সবাই ভালো নেই। তারা আচরণে অতটা সভ্য নয়। নয় শিক্ষায়, দক্ষতায়।

দেশের অবস্থার সাথে কি ঐ গল্পটি মেলাতে পারছেন? আচ্ছা, আমি মিলিয়ে দিচ্ছি। ৩০ বছর আগে অফিসের যে চেহারা ছিল সেই চেহারা এখন আর নেই। পুরাতন ফার্নিচার বদল হয়ে নতুন ফার্নিচার এসেছে। টাইপ মেশিনের যায়গায় এসেছে কম্পিউটার। ফ্যানের বদলে এসেছে এয়ার কন্ডিশন। স্যার তো দুরের কথা, স্যারের পিওনের রয়েছে নিজস্ব স্মার্ট ফোন, মোটর সাইকেল। এমনই অনেক পরিবর্তন হয়ে সেই অফিসটি উন্নত হয়েছে। কিন্তু ওই অফিসের ঘুষ, দুর্নীতি আর আত্মসাত বন্ধ হয়নি। ওই অফিস যদি স্বর্ণ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় তবুও ঘুষ দুর্নীতি চলতেই থাকবে। স্কুল কলেজে, বই পত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার মান বাড়েনি। স্কুল ভবন চারতলা/পাঁচতলা অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ হয়েছে। শিক্ষকের জীবনমান এখনো সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের পুলিশের কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে, সততা আসেনি। ভাঙ্গা রাস্তাতেও কেউ ট্রাফিক আইন মানত না, ভালো রাস্তাতেও কেউ মানে না। আগে সাইকেল নিয়ে বখাটেরা স্কুলের মেয়েদের উত্যক্ত করত এখন মোটরসাইকেল নিয়ে করে। আগে চিঠি দিত এখন এস এম এস দেয়। এভাবে প্রতিটি বিষয় আলাদাভাবে দেখুন। আমরা আমাদের আশেপাশের জিনিসপত্র উন্নত করেছি কিন্তু স্বভাবটাকে একই রকমের আছে। ঠিক যেমনটি ওই ভিক্ষুক, থালার উন্নতি করলেও ভিক্ষা ছাড়তে পারেনি।

উন্নত দেশের ব্যবস্থা ও পরিবেশ আপনাকে জোর করে উন্নত স্বভাবের বানাবে। স্বভাব ভালো না হলে হলে আপনি হবেন সমাজচ্যুত হয়ে যাবেন। ওদিকে আমাদের সমাজে ভালো স্বভাব হলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। আমাদের সমাজ আমাদের স্বভাব নষ্ট করতে বাধ্য করে। এটাই একটা পিছিয়ে পড়া দেশের সবচেয়ে বড় লক্ষণ। আমাদের এই ব্যবস্থাটা ঠিক করার কোন ইচ্ছা কারো নেই। সবাই আছে দৌড়ে কিভাবে আগে যাওয়া যায় সেই ধান্দায়। উন্নত দেশগুলিতে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি রয়েছে সেটা হল স্বাধীনতা। রয়েছে অন্যের সমস্যা না করে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার। উন্নত দেশে বস্তা ভরা টাকা নেই। রয়েছে সব প্রয়োজন মিটিয়ে ভালো থাকার নিশ্চয়তা।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কেন জানি সব উন্নয়ন রাস্তায় গিয়ে ঠেকে। অমুক সরকার, তমুক নেতা দেশের বা এলাকার উন্নতি করল কিনা সেটা আমরা পরিমাপ করি তারা কতটা রাস্তা করেছে এই দেখে। অমুক সরকারের আমলে অমুক এলাকায় রাস্তা হয়েছে, তমুক নেতা এলাকায় ব্রিজ বানিয়েছেন, তমুক নেতা হাসপাতাল বানিয়েছেন, তমুক নেতা স্কুল/কলেজ বানিয়েছেন। ব্যাস, ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই উন্নতিগুলো ওই ভিক্ষার থালা উন্নতির মতন। ওই রাস্তায় ইট বালি সিমেন্টের কারচুপি হয়ে রাস্তাটা অকেজো হয়ে যাবে। ওই হাসপাতালের ডাক্তার নিজের চেম্বার সামলিয়ে হাসপাতালে সময় দিতে পারবে না। উন্নতি কিছুই হল না!!

যদি কোনদিন কোন সরকার বাংলাদেশ থেকে শিক্ষায় বাণিজ্য কমাতে পারে, শিক্ষকের জীবনমান উন্নত করে নৈতিকভবে জীবন যাপনের চর্চার সুযোগ করে দিতে পারে তবে সেটা হবে লক্ষ স্কুল বানানোর চেয়ে বড় উন্নয়ন। যদি হাসপাতালে ডাক্তারদের সঠিকভাবে নিষ্ঠার সাথে কাজ করাতে পারে তবে সেটা হবে হাজার হাসপাতাল বানানোর চেয়ে বড় উন্নয়ন। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাসি কর্মকান্ড বন্ধ করতে পারে তবে সেটা হবে শত বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর চেয়ে বড় উন্নয়ন। যদি পুলিশকে সততার প্রতীক বানাতে পারে, সেটা হবে দেশের উন্নয়ন। যদি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারে সেটা হবে দেশের উন্নয়ন। যদি রাজনীতিবিদকে ব্যবসায়ী না বানিয়ে স্বেচ্ছাসেবী বানাতে পারে তাহলে হবে দেশের উন্নয়ন। যদি বখাটে যুবককে স্বাবলম্বী করার মত কাজ দিতে পারে সেটা হবে উন্নয়ন।

 এমন উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য দেশের নেতাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। যদি অন্তত অর্ধেক বুদ্ধি ও সম্পদ দেশের অমন উন্নয়নের জন্য খরচ করত তাহলে আমাদের আজ এই দশা হত না।


Categories