
রাজনীতির সাথে দেশপ্রেমের সম্পর্ক কতটুকু? এই প্রশ্নের উত্তর কার কাছে কেমন জানি না। আমার মনে হয় রাজনীতির সাথে দেশপ্রেমের স্ম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। শুধু নিবিড় নয় রাজনীতি ও দেশপ্রেমকে আমার কাছে পরস্পর সমার্থক বলেও মনে হয়।অর্থাৎ রাজনীতি মানেই দেশপ্রেম বা দেশপ্রেমের মধ্যেই রাজনীতি নিহিত। একটিকে ছাড়া অন্যটি পূর্ণাঙ্গ নয়। দেশপ্রেম বিহীন রাজনীতি যেমন অঃন্তসারশূন্য ফাঁকা বুলি মাত্র তেমনি রাজনীতি বিহীন দেশপ্রেম ঝিনুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা মুক্তার মতই।তাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক হতে হলে যেমন রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা জরুরী তেমনি রাজনীতি করতে হলে সবার উপরে দেশপ্রেমকে স্থান দেওয়াও জরুরী। শুধু তাই নয় যার মধ্যে দেশপ্রেম নেই তার রাজনীতি করার অধিকার আছে বলেও আমি মনে করি না। আবার একজন দেশপ্রেমিক যদি রাজনীতির খোঁজখবর না রাখেন তবে তার দ্বারা দেশ খুব সামান্যই উপকৃত হবে। অথচ,দুঃখজনক সত্য হল এই যে, আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনীতিবিদের মধ্যে দেশপ্রেমের বড়ই অভাব রয়েছে। তারা যেন রাজনীতি করেন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি লাভের আশায়। আবার অনেক দেশপ্রেমিক মানুষ রয়েছেন যারা রাজনৈতিক দুরাবস্থা দেখে দেশের ভাল মন্দ নিয়ে কথা বলার সৎসাহস হারিয়ে ফেলেছে। এর ফলে দেশ এখন রাজনৈতিক বন্ধাত্বের চরম দুঃসময় পাড় করছে। এর দায় রাজনীতিবিদদের উপরই বর্তায় বেশি। তবে দেশপ্রেমিক নাগরিকদেরও এই দায় একেবারে কম নয়। প্রচলিত রাজনীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে রাষ্ট্টীয় ক্ষমতার পেছনে ছুটছে বলে ধর্মীয় আদর্শ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। যদিও আমি মনে করি উন্মাদনহীন সহিষ্ণু ধর্মীয় আদর্শও রাষ্ট্ট পরিচালনায় বা জনকল্যানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। বিপত্তি হল এই যে, ধর্মীয় আদর্শবাদীরা বরাবরই অসহিষ্ণু হয়ে থাকে। এই অসহিষ্ণুতা বা উন্মাদনা শুধু যে বাংলাদেশে তা কিন্তু নয়। ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রত্যেকটি দেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই উন্মাদনা আরও বেশি। আদর্শ বিবর্জিত রাজনীতি বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। রাজনৈতিক আদর্শের মূলমন্ত্র হল দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য হবে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক আদর্শ দেশের মানুষের জান মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিবে।অন্য,বস্ত্র, বাসস্থানসহ সকল মৌলিক অধিকার ও মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করবে। কিন্তু যখনই রাজনীতি এই আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠে তখনই কোন না কোন আদর্শবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জণগণ প্রচলিত ধারার বাইরে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক স্রোতধারার সাথে মিশতে থাকে। এই ভিন্ন আদর্শবাদী ধারাটি যদি হয় ধর্মীয় প্লাটফর্ম তাহলে অতি অল্প সময়ে ফোলে ফেঁপে উঠে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না ক্ষমতার দাপট কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ দেখিয়ে খুব বেশি সংখ্যক মানুষকে ধরে রাখা সম্ভব নয় যা আদর্শিক চেতনা দ্বারা সম্ভব।
পৃথিবীর সব দেশের সব ধর্মের মানুষেরই বড় দুর্বলতার জায়গাটি হল ধর্মীয় বিশ্বাস, ধ্যান-ধারনা,আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি। তাই রাজনীতিতে যদি ধর্মকে পুঁজি করা যায় তবে খুব সহজেই সফলতার মুখ দেখা যায়। এর কারণ হল, একদিকে ধর্ম মানুষের পারলৌকিক জীবনের সুখ শান্তির নিশ্চয়তা দেয় এটি যেমন মানুষরে চিরকালীন বিশ্বাস অন্যদিকে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি মানুষের জাগতিক সুখ সমৃদ্ধি, যুশ-জৌলুস ও প্রভাব -প্রতিপত্তির নিশ্চয়তা বিধান করে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় দুর্বল দিক হল তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাদের এই দুর্বলতার কারণ হল এই যে, তারা সব সময় সবকিছুতে ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তা করতে অভ্যস্থ। কিন্তু ধর্ম তো কোন রাষ্ট্টীয় সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয়। অন্যভাবে বললে বলা যায় ধর্ম সব সময় সত্যানুসারী হলেও রাজনীতি সব সময় সত্য পথে চলে না। তাই রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে প্রায়ই একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করে। আধুনিক রাষ্ট্টসমূহ ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্ট দর্শন দ্বারা এতটাই প্রভাবিত যে রাষ্ট্টীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্ট ন্যায় অন্যায়,সত্যাসত্যের বাছ বিচার করে না। এমন কি ব্যাপক সহিংসতায় অসংখ্য প্রণের বিনিময়ে হলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে কোন দ্বিধা করে না। অথচ, সত্য ও ন্যায় অনুসারী ধর্মীয় আদর্শ কোনভাবেই ম্যাকিয়াভেলিবাদের এমন নীতিকে মেনে নিতে পারে না। তবে প্রকৃত ধর্মীয় আদর্শের সাথে দেশপ্রেমের যেমন কোন বিরোধ নেই তেমনি প্রকৃত রাজনীতিও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত।তাই যে যে ধারার রাজনীতিতেই বিশ্বাস করেন না কেন রাজনীতি যেন দেশপ্রেম বিবর্জিত অপ-রাজনীতি না হয় সেটি নিশ্চিত করতেই হবে। অন্যথায়, রাজনীতিতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হলে স্বার্থান্বেষী মহল এর সুযোগ নিতে পারে।
মিঞা মোহাম্মদ এলাহি
প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি
আব্দুস সাত্তার ডিগ্রী কলেজ
অরুয়াইল, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।