“দাঁড়াতে পারিনা ওদের কাতারে” আনোয়ারুল ইসলাম বিদ্যুৎ

প্রকাশিত: ৮:৩৩ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২০

আমার বাবা গ্রামের একজন ক্ষুদ্র কৃষক বটে
বাবার হাত ধরেই বেড়ে উঠেছি আমি এই ভুবনে।
আমি আমার বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি
আমাকে লেখাপড়া করাইয়ে এত বড় করতে
বাবা আমার কি কষ্টইনা করেছে তাঁর জীবনে।

অর্থ কষ্ট সে যেন
নিত্য দিনের সঙ্গী ছিল আমাদের সংসারে
আমার লেখা পড়ার খরচ দিতে গিয়ে
বাবা আমার ভলো কিছু কিনতে পারতনা
কখনও বাজারে গিয়ে।
লবন, তৈল,মরিচ, পিঁয়াচ,রসুন আলো
বাবার কিনতে হয়েছে অনেক কষ্ট করে।

মাছ, মাংস,ডিম,দুধ,এ যেন কল্পনা করাও যেতনা
সংসারের আয় অনুযায়ী ঐ সব খাদ্য
সব সময় ছিল আমার বাবার
ক্রয় সীমানার বাইরে।
তাই বাবা আমার অধিকাংশ সময় ভাত খেয়েছে
শুকনো মরিচ আর পিঁয়াচ ভর্তা করে।
বাবা আমার কি কষ্টইনা করেছে তাঁর জীবনে।

বাবা আমার স্বপ্ন দেখেছিল আমাকে নিয়ে
আমি যেন বড় হয়ে অনেক বড় চাকুরি করে
সংসারের অভাব দুর করে দিব
প্রতি মাসে বেতন পেয়ে বাবাকে বলবো ?
বাবা তোমাকে আর যেতে হবেনা লাঙ্গল নিয়ে
তোমাকে আর চিন্তা করতে হবেনা সংসার নিয়ে ।

লেখা পড়া শেষ করে আসলাম বাড়িতে
কোথাও কোন চাকুরি না পেয়ে
বাবার শেষ সম্বল
ফসলের ঐ জমিটুকু বন্ধক দিয়ে
চাকুরি নিলাম নতুন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়
রুটিন অনুযায়ী ক্লাসও করাতে হয়
বাবা আমার একটু একটু করে হাসে
ছেলে আমার চাকুরি করে
আর থাকবেনা কোন অভাব আমার সংসারে।

মাস শেষ হয়।
বাবা আমার দিকে শুধু তাঁকিয়ে রয়।
আমি বুঝতে পারি বাবা কি বলতে চায়
বাবা শুধু বার বার আমার দিকে ফিরে তাঁকায়
বাবার দিকে তাঁকিয়ে আমি কিছুতেই বলতে পারিনা
আমি যে চকুরি করি বেতন পাইনা।

বাবাকে কি করে বলি?
বাবা।
আমি যে চাকুরি করি বেতন পাইনা।
দু একটা টিউশনি করি সেই টাকা দিয়ে
আমি নিজেই সারা মাস চলতে পারিনা ।

বাবা আমার চাকুরির অবস্থা বুঝতে পেরে
এক খন্ড জমি বিক্রি করে
বন্ধক দেওেয়া জমি ফেরত এনে
আবার ফসল আবাদ শুরু করে।

আমি নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে যাই আসি
কি সুন্দর চাকুরি ?
সময় মত হাজিরা দিতে হয়
নিয়মিত ক্লাস করাতে হয়
প্রতিষ্ঠানের সকল নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়
শুধু বেতন চাইলেই কতৃপক্ষ নিরব রয়।

সমাজের বন্ধু বান্ধব সকলের সাথে
তাল রেখে আমাকে চলতে হয়
বাবা আমার শুধু অপেক্ষায় রয়
দিন যায়,মাস যায়,বছর পার হয়ে যায়
বাবা যেন আমার দিকে অাগের চেয়ে
অনেকটাই কম কম ফিরে তাকায়।

বয়সের বারে রাত দিন খাটাখাটি করে
বাবার শরীরটা একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে
তার পরেও সংসারের চাপ
সেই বাবাকেই বইতে হইছে।

আমি বাবাকে কখনও দিতে পারিনা
একটু স্বান্তনা দেওেয়ার ভাষা
বাবাকে দিতে পারিনা একটু সুখের আশা
উল্টো বাবার ঘারে বাবার কামাই খেয়ে
বিনা বেতনে প্রদিপ জ্বালাই আমি অন্যের ঘরে।

বাবা আমার বৃদ্ধ বয়সেও কি কষ্ট এখনও করে
আমি আজও যেন ননীর পুতুল বাবার সংসারে।

আমার যেন বিয়ের বয়স পার হতে চলেছে
ঐ পাড়ায় আমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে
অভাবের যন্ত্রণায় আস্তে আস্তে সেউ ভুলে যাচ্ছে।

চাল নেই, চুলা নেই,চাকুরি আছে বেতন নেই,
অভাব অনটনের মধ্যেই চলছে বাবার সংসার
বাবা কিছুতেই যেন আরও একজনের দায়িত্ব
নিতে চায়না আর।

আমার বয়সের দিকে চেয়ে
আত্মীয় স্বজনের চাপে
বিয়ে দেয় আমায়
বউ আসে আমার ঘরে।
কিছু দিন যেতেই না যেতেই
অভাবের কারণে বউ আমায় শুধু তিরস্কার করে।
এরই মধ্যেই আবার
নতুন অতিথি আসল আমার ঘরে
আমি যেন বাঁধা পরে গেলাম আমার সংসারে।

টিউশনি করে সামান্য কিছু অর্থ রোজগার করি
কোন রকমে তা দিয়ে যেন
স্ত্রী ও সন্তানের চাহিদা পূরণ করি।
এরই মধ্যে বউ আমার বায়না ধরে
থাকবেনা আর এক সাথে বাবার সংসারে
বাবা তা শুনতে পেয়ে পাঁচ কেজি চাল দিয়ে
তাড়াতাড়ি দেয় আমায় আলাদা করে।

সল্প আয়ে কিছুতেই সংসার যে চলেনা আমার
আমি কি ভাবে খোঁজ রাখি আবার বাবার ?
দুই মাস হতে চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ
কোচিং সেন্টারটিও লকডাউনে আছে সেটাও বন্ধ
বাসায় গিয়েও পড়াতে পারছিনা করোনার ভয়ে
দুই মাস যাবৎ কোন টাকা আসছেনা পকেটে
পরিবার পরিজন নিয়ে আছি মহা সংকটে।

সরকার ও বিত্তবান মানুষ ত্রাণ দিচ্ছে
খেটে খাওয়া দিন মজুরদের ঘরে
কেউ কি একবার চিন্তা করেছে?
আমিও যে ওদের কতারে?

ওরা কাজ করে রাস্তায়, ঘাটে, মাঠে
আমিও যে কাজ করি নতুন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
আর একটি কোচিং সেন্টারে।
প্রতিষ্ঠান এম পিও ভুক্ত না হওয়ায়
আমাকেতো বেতন দেয়না
এই দেশের সরকারে।
আমাকে যে পেটের ভাত যোগাতে হয়
প্রতিদিন আমার মেধা আর শ্রম বিক্রি করে
আমিও যে ঐ খেটে খাওয়া
দিন মজুরদের কাতারে।

বেশ কয়েক দিন যাবৎ কোন বাজার নেই ঘরে
কিছু চাল আছে হয়ত আর কিছু দিন যেতে পারে
বাচ্চার খাবারের দুধ নেই
পকেটে নগদ কোন টাকা নেই আমার
কারও কাছে দার দেনাও পাওয়া যাচ্ছেনা আর
কি নিয়ে দুধ কিনতে যাবো বাজারে ?

কত প্রকারের ত্রাণ আর রেশন দিচ্ছে সরকারে
আমি যে কিছুতেই কাউকে বলতে পারিনা
কি ভয়াবহ খাদ্য ও নগদ অর্থের অভাব এখন
বিরাজ করছে আমার সংসারে।

আমি যে ত্রাণ আনতে পারছিনা ?
ঐ লাইনে দাঁড়িয়ে?
সারা দেশে আমার মত হাজার হাজার
নন এম পিও ও খন্ড কালিন প্যাড়া শিক্ষক
তেমনি সারা দেশের কিন্ডারগার্টেনে
কর্মরত শিক্ষক আছে হাজার হাজার
সবাই যে আজ ঐ খেটে খাওয়া
দিন মজুরদের মতই কর্মহীন বেকার।
কঠিন ভয়াবহ খাদ্য অভাবের মধ্যে দিয়েই
চলছে আমাদের দেশের এই
বেতন বিহীন শিক্ষকদের সংসার।

দেশের প্রিন্ট মিডিয়া গণমাধ্যমে এখন সারাক্ষণ
প্রাচার করছে দেশের কর্মহীন বিভিন্ন পেশার লোকদের অভাবের ও ব্যবসায়ীদের লোকসানের খবর
আমারাও যে একটি শ্রেণি আছি অনাহারে
কেউ রাখেনা আমাদের সংসারের খবর।

আমাদের নিয়ে কোন দানবীর
চিন্তার করার নাই যে একটু সময়
আমি দাঁড়াতে পারিনা ওদের কাতারে?
কে সাহায্য দিবে আমারে ?
আমি যে আজ কয়েকদিন যাবৎ অনাহরে
আমি যাবো কোন দানবীর দ্বারে ?
সবাই আমাকে দেখে বলবে ?
সেতো শিক্ষকতা করে ?
তাঁর আবার খাদ্য থাকেনা কিভাবে ঘরে?

শিক্ষিত ভদ্রলোক আজ লজ্জায় মরে দুধ


Categories