
প্রদীপ কুমার সাহা ; (শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ)
করোনাকালে শিশুরা এখন কয়েকটি নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হচ্ছে, যা তাদের মনের মণিকোঠায় উদ্বেগ, আতংক আর কৌতুহলের সৃষ্টি করছে। যেমন : লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, ভেন্টিলেশন ইত্যাদি। এই শব্দগুলো তাদের কাছে একদম নতুন এবং অনেক শিশুই এগুলোর সঠিক অর্থ জানে না। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট দীর্ঘ লকডাউনের কারণে বয়োবৃদ্ধরা যেমন আতংকিত সময় পার করছে , ঠিক তেমনি শিশুদের মনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিশুরা সাধারণত অনেক কোমল মনের হয় এবং বড়দের আচরণ অনুকরণ করে। দেখা যায়, কোন প্রতিকূল পরিবেশে যদি শিশু মানসিক চাপ অনুভব করে, তখন সে চুপচাপ হয়ে যায় আবার কখনো বা বিরক্তিবোধ করে।
করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে শিশুরাও বড়দের মতই গৃহবন্দি। শিশুরা বুঝতে পারছে না, করোনা ভাইরাস কী? কেনইবা তাদের সারাক্ষণ ঘরেই থাকতে হচ্ছে। কেনইবা স্কুলের স্যারেরা ক্লাস করছে না , পরীক্ষা নিচ্ছে না, কেনইবা তাদের খেলার সাথীরা মাঠে আসছে না। তাদের আবেগ ও আচরণের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন আমরা দেখতে পারছি। কেউ হয়তো বা অকারণে জেদ করছে আবার কেউবা বাহিরে বন্ধুদের সাথে মেলামেশার বায়না ধরছে। দীর্ঘ দিনের আবদ্ধ অবস্থা শিশুর মনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। একটা শিশু যখন হাটতে শেখে , কথা বলতে ও দৌঁড়াতে শেখে এসব জিনিস তার বিকাশের অংশ। গৃহবন্দি অবস্থায় থেকে শিশুদের মধ্যে যেভাবে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, একাকীত্ব অবসাদের প্রকোপ বাড়ছে তাতে শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট এর মতে, চারদিকে শুধু শংকার আবহ শিশুর মনোজগতের উপর মারাত্বক প্রভাব ফেলবে।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে তা হয়তো আগামী বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। দেশের বিভিন্ন এলাকার কিছু স্কুল অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও গ্রামের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সরকারি টেলিভিশনে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম চালু হলেও গ্রাম এলাকার অনেকেই তা জানেন না। লকডাউন শেষে তরিঘড়ি করে সিলেবাস শেষ করতে শিক্ষক যখন উদ্যোগী হবেন, তখন শিশুরা তার সাথে তাল মেলাতে না পেরে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
দীর্ঘ লকডাউনে ব্যবসা বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকার কারণে মন্দা, বেকারত্ব ও দারিদ্রের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়বে। শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাবে। কখনো বা শিশুরা পাচারের শিকার হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা বলছে, ২000 সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের হার কমেছিল ৯৪%। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এর প্রবণতা উল্টোপথে যাওয়ার ঝুকি তৈরি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শিশু আবারও শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হবে বলে সংস্থাটি আংশকা প্রকাশ করছে।
বিশিষ্ট পিডিয়াট্রিশিয়ানদের মতে পরিবারে খাদ্য সংকটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। তাঁরা মনে করেন, অনেকেরই বেতন বন্ধ হয়ে গেছে, চাকুরী চলে গেছে। এসব ঘরেতো খাবার ঠিকমত আসছে না। সে কারণে শিশু লম্বায় বড় হওয়া, ওজন বাড়া এসব কমে যাবে।
প্রাণের ভয় ও আর্থিক অস্বচ্ছলতায় অসহায় হয়ে পড়ছে মানুষ। যেন এক অন্ধগলিতে ঢুকে পড়ছে সবাই, যা থেকে বের হবার কোন উপায় জানা নেই।
করোনার কারণে সৃষ্ট একাকীত্ব, অবসাদ, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর মানসিক যন্ত্রণা আমাদের শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘ মেয়াদী একটা ট্রমা দেখা যাবে। তাই এই সংকট উত্তোরণে সৌহাদ্যপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক, মনোসেবা বা কাউন্সেলিংই হতে পারে একটা উত্তম পন্থা।