
এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রবেশনারি পদ হচ্ছে প্রভাষক। ফলে সংগত কারণেই এই পদের সুযোগ সুবিধা বেশি হওয়ার কথা।কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এই পদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর বদলে শুধু কমানোই হচ্ছে।মূলতঃ ৫ঃ২ তথা অনুপাত প্রথার কারণে প্রভাষকদের জীবনমানের বারোটা বেজেছে। আর জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এ বৈষম্যের পাহাড় রচনা করে প্রভাষকদের যেটুকু আশা অবশিষ্ট ছিল তার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ এর এমপিও নীতিমালার ১১.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “ এমপিওভূক্ত প্রভাষকগণ প্রভাষক পদে এমপিওভূক্তির ৮(আট) বছর পূর্তিতে ৫ঃ২ অনুপাতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। এতে মোট পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবেনা। অন্য প্রভাষকগণ এমপিওভূক্তির ১০ বছর সন্তোষজনক চাকরি পূর্তিতে বেতন গ্রেড ৯ থেকে ৮ প্রাপ্য হবেন।”
এই অনুচ্ছেদটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৮ বছর পর একটি কলেজের ৭ জন প্রভাষকের মধ্য হতে ২ জনকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে (৬ষ্ঠ গ্রেডে) পদোন্নতি দেওয়া হবে। অর্থাৎ ২৮% সৌভাগ্যবান প্রভাষক শুধুমাত্র আগে যোগদান, এমপিওভূক্তি কিংবা বয়সে বড় হওয়ার কারণে সহকারী অধ্যাপক পদে (৬ষ্ঠ গ্রেড, বেতন স্কেল ৩৫৫০০) পদোন্নতি পাবেন। হতভাগা অবশিষ্ট ৭২% প্রভাষক ১০ বছর পর ৯ম গ্রেড(২২০০০) থেকে ৮ম গ্রেডে (২৩০০০)উন্নীত হবেন। প্রসঙ্গত, ৯ম গ্রেড থেকে ৮ম গ্রেডের ব্যাবধান মাত্র ১ হাজার টাকা। একই পদে একই যোগ্যতায় চাকুরি করে কারো ৮ বছর পরে পদোন্নতি সহ বেতন বাড়বে ১৩৫০০ টাকা আর অবশিষ্ট অধিকাংশের ক্ষেত্রে সারা জীবন পদোন্নতি তো পাবেনইনা বরং ১০ বছর বেতন বাড়বে মাত্র ১ হাজার টাকা! এটা অত্যন্ত অযৌক্তিক, অমানবিক এবং বৈষম্যমূলক।এ রকম কালো আইন বোধ হয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই।অথচ ১৯৯৫ এর নীতিমালা অনুযায়ী প্রভাষকরা ২ বছর পূর্তিতে ৮ম গ্রেড এবং ৮ বছর পূর্তিতে ৭ম প্রেড পেতেন।২০১০ এর এমপিও নীতিমালায় ২ বছর পর ৮ম গ্রেডের বিধান পরিবর্তন করলেও ৮ বছর পর ৭ম গ্রেড বহাল রাখা হয়।(এমপিও নীতিমালা ২০১০, অনুচ্ছেদ ১১,.৪)।
সরকারি কলেজের প্রভাষকরা প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেও এমপিওভূক্ত কলেজের প্রভাষকরা সারাজীবনে মাত্র একটি পদোন্নতি পান। তাও আবার অনুপাত প্রথার কারণে ৭২% প্রভাষক আজীবন একই পদে থেকে অবসরে যেতে হয়।দেখা যায় একজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক অবসরের সময়েও প্রভাষক অথচ উনার ছাত্র সহকারী অধ্যাপক হয়ে গেছে। এ যে কত হৃদয় বিদারক তা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা বোধ হয় সম্ভব নয়। আগের নীতিমালাগুলোতে পদোন্নতি বঞ্চিত প্রভাষকরা ২ বছর পর ৮ম গ্রেড এবং ৮ বছর পর ৭ম গ্রেড পেয়ে কিছুটা সান্ত্বনা পেতেন। কিন্তু ২০১৮ এর নীতিমালায় ১০ বছর পর ৮ম গ্রেড তথা ১ হাজার টাকা বৃদ্ধি করার বিধান করায় প্রভাষকদের শেষ ভরসাটুকুও আর রইলনা।
২০১০ এর নীতিমালায় প্রভাষকরা ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় অধ্যক্ষ/ উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে পারতেন। কিন্তু ২০১৮ এর নীতিমালায় অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে ১২ বছরের অভিজ্ঞতার সাথে সহকারী অধ্যাপক পদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতার বিধান করা হয়েছে। ফলে কপালদোষে যারা সহকারী অধ্যাপক হতে পারলেননা, তাদের ভাগ্যে আর কিছুই রইলনা।
বেসরকারি শিক্ষকরা এমনিতেই পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, পেনশন সহ নানা বৈষম্যে জর্জরিত, তার উপর এভাবে প্রভাষকদের সুবিধা একের পর এক কমিয়ে দেওয়া কোন শুভ লক্ষণ নয়। তাহলে কি মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হয় তার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করা হচ্ছে?
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১২ নভেম্বর এমপিও নীতিমালা সংশোধনের লক্ষ্যে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে ১ মাসের ভিতরে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করার জন্য বলা হয়েছিল। নীতিমালা সংশোধন কমিটির কাছে বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষকদের দাবিদাওয়া সম্বলিত সুপারিশমালা পেশ করে।এছাড়া কলেজ শিক্ষক পরিষদ সিলেট এর পক্ষ থেকে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।ণীতিমালা সংশোধন কমিটির কয়েকটি বৈঠকে উক্ত সুপারিশমালা নিয়ে আলোচনা হলে শিক্ষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। তবে বেশকিছু দিন ধরে উক্ত কমিটির কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।কিন্তু সম্প্রতি এমপিও নীতিমালা ২০১৮ এ কোন পরিবর্তন না এনে উচ্চতর স্কেলের আবেদন চালু করায় হতাশা ও ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন প্রভাষকরা।১০ বছর চাকুরির পর ১ হাজার টাকা বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেননা কেউই।
প্রভাষকদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে এমপিও নীতিমালা সংশোধন কমিটির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে দেশের কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি কলেজের লক্ষ লক্ষ প্রভাষকদের পক্ষে নিম্নোক্ত সুপারিশমালা পেশ করছি।
১) অনুপাত প্রথা বাতিল করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর সকল প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিতে হবে।সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করতে হবে।
২) পদোন্নতি বিলম্বিত প্রভাষকদের ১০ বছর পূর্তিতে ৭ম গ্রেড প্রদান করতে হবে।
৩) অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রভাষকদের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনের সুযোগ দিতে হবে।
৪) সর্বোপরি মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে চলতি বছরেই শিক্ষাব্যাবস্থা জাতীয়করণ চাই।
লেখক:
যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম
কেন্দ্রীয় কমিটি।