অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদে প্রভাষকদের আবেদনের সুযোগ চাই

প্রকাশিত: ৫:১৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৩, ২০২০

কালের পরিক্রমায় বিধিবিধান হয় আরো উন্নত , আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক ও জনবান্ধব। যা যোগ্য নাগরিক তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা 2018 এর অধিকাংশ নীতিমালা শিক্ষাবান্ধব হলেও কলেজ পর্যায়ের অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধিমালায় ঘটেছে তার উল্টোটি।
আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সহকারি (শিক্ষক) মৌলভী থেকে আসা সুপার , সহ-সুপারদের অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ হওয়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা হলেও প্রভাষকের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপকের শর্ত জুড়ে দেয়ায় এই স্তরে শিক্ষাদানকারী প্রভাষকগণ দরখাস্ত করার অযোগ্য হয়েছেন। আসুন এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এর অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দিক পর্যালোচনা করে দেখি।

১।আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে – উপাধ্যক্ষ/সহকারী অধ্যাপক পদে ০3 বছরের অভিজ্ঞতা সহ প্রভাষক হিসেবে (আরবি বিষয় সমুহে) মোট 12 বছর শিক্ষকতা অভিজ্ঞতা।
অথবা- দাখিল মাদ্রাসার সুপার হিসেবে 5 বছরের অভিজ্ঞতাসহ (আরবি বিষয় সমুহে) 15 বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা।
*উপরোক্ত ধারায় প্রভাষকদের ক্ষেত্রে “সহকারী অধ্যাপক” শর্ত জুড়ে দেয়ার কারণে উক্ত স্তরে শিক্ষাদানে যাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে সেই প্রভাষকগনকে আবেদনে অযোগ্য করা হলো।
[কারণ বিদ্যমান আইনে সহকারী অধ্যাপক পদ আদিমযুগের অনুপাত প্রথায় সীমাবদ্ধ থাকার কারণে এটি জন্মগত পদ হয়ে গেছে। যতই যোগ্য, মেধাবী হোক কোনভাবেই অন্য প্রভাষকগণ এই জনমে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ পাবেন না।
অথচ 2010 এর নীতিমালায় এই শর্তটি ছিলনা। ওই নীতিমালায় ছিল প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক।ফলে সকলের আবেদনের সমান সুযোগ ছিল।]
*অথবা- অংশে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালার ইতিহাসে নজিরবিহীন বিধি যোগ করা হয়েছে। যাতে দাখিল মাদ্রাসার সুপারদের সুযোগ দেয়া হয়েছে অধ্যক্ষ/ উপাধ্যক্ষ হওয়ার। বিগত জীবনে যিনি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠদানে কখনো জড়িত ছিলেন না এবং স্কুল লেভেলের দাখিল মাদ্রাসায় সহকারি মৌলভী থেকে সুপার হয়েছেন। তিনি অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগ পেলেন অথচ প্রভাষকরা বঞ্চিত হলেন।
2. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করতে শিক্ষার মানোন্নয়নে 2018 এর নীতিমালায় চমৎকার সংযোজন হল আলিম মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ পদ সৃষ্টি করা। কিন্তু এ পদের কাম্য যোগ্যতা ও পূর্বের 1 নং অধ্যক্ষ বিধিটির মত। প্রভাষকদের শর্তের বেড়াজালে বন্দি রেখে স্কুল লেভেলের দাখিল মাদ্রাসার সহ সুপার ও সুপারদের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
৩। অনুরূপভাবে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক কলেজ এবং ফাজিল , কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে প্রভাষকদের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক শর্ত জুড়ে দেয়ার কারণে প্রভাষকগণ আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছেন।
তবে কলেজগুলোতে মাদরাসার মত নজীরবিহীনবিধি যোগ করা হয়নি। স্কুল এন্ড কলেজগুলোতেও অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সহকারী শিক্ষক থেকে আসা প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের সুযোগ রাখা হয়নি কিন্তু মাদ্রাসায় করা হলো তার ব্যতিক্রম।
৪। কলেজের নীতিমালায় আরো কাংখিত ব্যতিক্রম রয়েছে-

স্নাতক (পাস) মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষপদ= এখানে কাম্য যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে- প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক। সবাইকে সুযোগ দেয়া হয়েছে।
তাই এটির মত কলেজ ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ পদে পূর্বের মত অভীজ্ঞতা সম্পন্ন প্রভাষকদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হোক।

অথবা সহকারী অধ্যাপকের পদে অনুপাত প্রথা বাদ দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে সকলের যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে তারপর সহকারী অধ্যাপক এর শর্ত জুড়ে দেয়া হোক।
৫। এই অর্থবছরে আলিম মাদ্রাসা গুলোতে উপাধ্যক্ষ নিয়োগ শুরু হয়েছে। যাতে দাখিল মাদ্রাসার সহ সুপার ও সুপারগণ আবেদন করতে পারছেন কিন্তু প্রভাষকগণ এই স্তরের অভীজ্ঞ শিক্ষক হওয়ার পরও বঞ্চিত হচ্ছেন।
এতে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির প্রতিযোগিতা থাকছে না।অধিক যোগ্য,অধিক অভীজ্ঞ ও অধিক শিক্ষিত হওয়ার পরও প্রভাষকগণকে অযোগ্য করে রাখা জাতির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অশনি সংকেত।
মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে যদি প্যারামেডিক ডাক্তারকে অধ্যক্ষ বানানো হয় তার এমবিবিএস কোর্সের ছাত্র কতটুকু যোগ্যতা নিয়ে গড়ে উঠবে চিন্তার বিষয়!
সর্বশেষ যোগ্যদের বঞ্চিত রাখার কুফল সম্পর্কিত একটি বাস্তব গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব।
যখন কাম্য অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোন কোন মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হতো, বিধিমালা প্রতিপালনে কড়াকড়ি না থাকায় এমপিওভুক্তও হয়ে যেতেন। সে সময়ে কোনো একজন শিক্ষক মাদ্রাসার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষক থেকে অধ্যক্ষ হলেন। তার অধীনস্থ উনার দৃষ্টিতে একজন ফাঁকিবাজ শিক্ষককে ধরার জন্য তিনি একদিন ওই শিক্ষকের ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বললেন সবাই বই বন্ধ করো এবং আজকের পড়াটা লিখ। অধ্যক্ষ খাতা গুলো সংগ্রহ করে সেই শিক্ষকের হাতে দিলেন মূল্যায়ন করার জন্য।সেই শিক্ষক খাতাগুলো হাতে নিয়ে প্রতিটি খাতায় টিক মার্ক দিয়ে অধ্যক্ষকে দিলেন। অধ্যক্ষ মহোদয় সব খাতায় টিক মার্ক দেখে খুশীতে বাগবাগ হয়ে বললেনঃ- আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনি নাকি পড়ান না। পড়াতে পারেন না। এখন দেখছি সবাই তো পড়া পারল। শিক্ষককে ব্যস! ব্যস! বলে ধন্যবাদ দিয়ে ক্লাস থেকে বাহিরে যাওয়া মাত্র ওই শিক্ষক অধ্যক্ষকে ডেকে আনলেন এবং তার সামনেই টিক মার্ক করা খাতাগুলোকে আবার ক্রস মার্ক দিলেন। অধ্যক্ষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।বিস্ময়ে বললেনঃ- এ কি করছেন!
শিক্ষক বললেনঃ- আমি সব খাতায় টিক দিয়েছি আপনি কি কিছু বুঝেছেন? আবার এগুলোকে ক্রস দিয়েছি এবার কি কিছু বুঝেছেন? না বুঝলে আমাদের উপর পোদ্দারি করতে আসেন কেন? এই ঘটনাটি আমাদের কি শিক্ষা দেয়?
আমরা বলছি না সবাই এমন হয়। আবার এও বলছি না কাউকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হোক বরং বলছি আমার সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে যোগ্য শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেয়া হোক। তাহলে যোগ্য ছাত্র গড়ে উঠবে। যেমন শিক্ষক তেমন ছাত্র হবে। “বাপকা বেটা সিপাহী কা ঘোড়া – কুচ নেহি থোরা থোরা”
মানুষ গড়ার কারিগরেরা মানুষের গড়া জালে আটকে গেলে , মানসম্মত শিক্ষা আটকে যাবে। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে বাস্তবতার মুখ দেখবে না।
তাই আমাদের শিক্ষা নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে মিনতি করব- নতুন নীতিমালায় শিক্ষার মান উন্নয়নে যুগান্তকারী অনেক বিধি সংযোজন হলেও শুধুমাত্র আলোচিত বিষয়টি সকল প্রভাষকদের ব্যথিত করেছে তাই এই জটিলতা দূরীকরণে অতীতের মতো আজও আপনাদের আন্তরিক ভূমিকা চাই।প্রভাষকেদের জন্য বৈষম্যমূলক সকল বিধির সংশোধণ চাই।
মানুষ গড়ার কারিগরেরা মানুষের গড়া জালে আটকে গেলে , আটকে যাবে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা।

লেখক
মোঃ মোস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবী)

খাড়াতাইয়া ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা।

বুড়িচং, কুমিল্লা


Categories